কুর্গ নামটা দার্জিলিং, কাশ্মীর, উটি, মুন্নার, মহাবালেশ্বর প্রভৃতির মতো খুব পরিচিত নাম না হলেও বর্তমানে অফবিট স্থান হিসাবে বেশ জনপ্রিয় কর্নাটকের এই ছোট্ট সবুজে ঘেরা শৈলশহরটি। তাছাড়া বর্তমানে ভারতের স্কটল্যান্ড হিসাবে সবিশেষ পরিচিতি পেয়েছে এই শহর। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে কোলকাতার গরম থেকে কয়েকদিনের জন্য রেহাই পেতে সপরিবারে যাত্রা করেছিলাম কুর্গ- এর উদ্দেশ্যে। বেঙ্গালুরু বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২৪৮ কিমির লম্বা সফর করে যখন পাহাড়ের গায়ের এই নিরিবিলি শহরটিতে পৌঁছাই সূর্য তখন অস্তাচলে। যদিও কুর্গ শহরের নিকটবর্তী বিমানবন্দর হল ম্যাঙ্গালোর, যেখান থেকে কুর্গ- এর দূরত্ব ১৬০ কিমি। আর সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন হল মাইসোর। এই শহরে কোনো রেলপথ নেই। কুর্গ শহরের কেন্দ্রবিন্দু হল মাদিকেরি। এখান থেকে কুর্গের সকল দ্রষ্টব্য খুব সহজেই ঘুরে দেখা যায়। তাই আমরাও মাদিকেরিতেই অস্থায়ী আস্তানা খুঁজে নিলাম। প্রথম রাতেই আমরা দেখেছিলাম এই শহরের এক অন্যরূপ। রাত তখন প্রায় আটটা। ছোট্ট পাহাড়ী শহরে তখন রাতের অর্ধেক নিরবতা। কিন্তু আমরা শহুরে মানুষ, এত তাড়াতাড়ি সেখানে রাতের নির্জনতা নেমে আসে না। যাইহোক আমরা তখন হোটেলের কাছাকাছি এক রেস্তোরাতে রাতের আহার করতে গিয়েছিলাম। প্রায় ১ ঘন্টা পর বাইরে আসতেই আমার মনে একটা লাইন ভেসে এল। ‘ঘিরে ধরে কুয়াশা যখন।‘ পুরো শহর যেন কুয়াশার সাদা চাদর টেনে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। সেই কুয়াশার আস্তরন এত’ই পুরু যে এক হাত দূরের কোনকিছুও দৃশ্যমান ছিল না। কুর্গে আমাদের প্রথম রাত ছিল প্রবল বর্ষনমুখর, যা আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল। কিন্তু পরদিন সকালে রোদ ঝলমলে আকাশ দেখে মনটা খুশিতে নেচে উঠেছিল। আমি বৃষ্টিপ্রেমী হলেও সেটা নিজের শহরে বসে।
কুর্গ শহরের প্রতিটি দ্রষ্টব্যই অনন্য। তবে আমার চোখে সবার সেরা মন্ডলপেট্টি (Mandalpetti)। এটি মাদিকেরি থেকে ৩০ কিমি মতো উচ্চতায় অবস্থিত। এই পথ এতোই পাথুরে ও বন্ধুর যে সেই পথে সাধারন, সৌখিন গাড়ি চলাচল সম্ভব নয়। অগত্যা আমরা মাদিকেরি থেকে একটা জিপ ভাড়া করে রওনা হলাম প্রায় ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ। যত এগোতে লাগলাম পথের কদর্যতা সমগ্র শরীর অনুভব করতে লাগল। ধরে না বসলে গাড়ি থেকে ছিটকে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। শেষের ৪ কিমি আবার হাঁটাপথ। তবে শারীরিক ক্লান্তি এক নিমেষে চলে গিয়েছিল সামনের দৃশ্য দেখে। মন বলে উঠেছিল, “ আহা! যা দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।“ মনে হল যেন মেঘের রাজ্যে এসে গেছি। এতো অসাধারন ভিউ পয়েন্ট আমি এখনো অব্দি আর দেখিনি।একটা প্রাচীর, তারপর শুধুই শূন্যতা আর মেঘের সারি। যেন হাত বাড়ালেই আকাশ ছুঁতে পারব। মন্ডলপেট্টি থেকে ফিরতি পথে দেখা পাওয়া যায় এক জলপ্রপাতের, যার নাম কোটা। জলপ্রপাতটি খুব উচ্চতা বিশিষ্ট নয়, তবে তার চারপাশের সবুজ অরন্য বেশ মনমুগ্ধকর। সেই অরন্যের প্রধান দুটি গাছ হল কফি আর গোলমরিচ। কুর্গ ভারতের কফি রাজ্য হিসাবে বিখ্যাত। আর একটি জিনিসের জন্যও কুর্গ সবিশেষ পরিচিত, যা হল গৃহস্থলিতে বানানো ওয়াইন, যাতে অ্যালকোহলের পরিমান খুবই কম। তাই কুর্গ বেড়াতে গেলে এই দুটো জিনিস কিনতে ভুলবেন না। জলপ্রপাত হিসাবে যদিও কুর্গে বিখ্যাত অ্যাবে (Abbey) জলপ্রপাত। সত্যি খুব সুন্দর এই জলপ্রপাত। তবে ভালো কিছু পেতে গেলে একটু কসরত তো করতেই হয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় শ দুয়েক সিঁড়ি নেমে যে সুন্দর দৃশ্য নজরে পড়ছিল, তার জন্য এটুকু কষ্ট করাই যায়। তবে ওই সিঁড়ির সংখ্যা কিন্তু আনুমানিক। আপনারা যদি কেউ যান ও সিঁড়ি গুলি গুনে থাকেন, আমায় কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।
পাহাড়ে বেড়ানো মানেই সবার আগে মনে আসে ভিউ পয়েন্ট। আর মন্ডলপেট্টির পর আমার প্রিয় স্থান রাজা’স সিট (Raja’s Seat) । কুর্গের অন্যতম প্রধান আকর্ষন এই রাজা’স সিট। ওই একই স্থানে আছে রাজা’স টম্ব (Raja’s Tomb) । এখান থেকে চারিপাশের ভিউ তো অসাধারন’ই, স্থানটির নিজস্ব চমক ও কোনো অংশে কম নয়, যাকে বলে ছবি তোলার আদর্শ স্থান। শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য এখানে আছে টয়ট্রেন।
কুর্গ শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান গুলি হল- ওমকারেশ্বর মন্দির, পরিচিত দক্ষিন ভারতীয় ধাঁচে নির্মিত রঙবেরঙের সুসজ্জিত মন্দির। দুবারে এলিফেন্ট ক্যাম্প (Dubare Elephant Camp), যদিও সেখানে হাতি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, তবে সুযোগ হয়েছিল নৌকা চালানোর। তলাকাবেরী (Talakaveri), এটি হল কাবেরী নদীর উৎস স্থল। মাদিকেরি দূর্গ (Madekeri Fort) , যা এই শহরের প্রাচীনতার নিদর্শন। কাবেরী নিসর্গধাম, একটি সুসজ্জিত পার্ক।আর তিব্বতী স্বর্ন গুম্ফা ( Tibetan Golden Monastery), আমার কাছে এটি কুর্গের তৃতীয় সুন্দর স্থান। বৌদ্ধ গুম্ফা আমার বরাবরই খুব পছন্দের হয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে অনেক তিব্বতী লামারা থাকে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।
আমাদের দু রাত্রি তিন দিনের কুর্গ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা খুব ভালো। আর হাতে যদি সময় থাকে তো মাইসোর, বেঙ্গালুরু তো ঘুরতেই পারেন, এছাড়াও পৌঁছে যেতে পারেন জনপ্রিয় শৈলশহর উটি, যার দূরত্ব ২৩২ কিমি মতো। সময় লাগতে পারে ঘন্টা ছয়েক। আর যেতে পারেন কেরালার ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ওয়ানাড – এ, যেখানে প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। ওয়ানাড দূরত্ব কুর্গ থেকে প্রায় ১২৫ কিমি, সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘন্টা। আমরা হাতে থাকা ছুটিকে উপভোগ করতে পৌঁছে গিয়েছিলাম ওয়ানাড- এ।
কুর্গ সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে কর্নাটক ট্যুরিসিম এর ওয়েবসাইটে ক্লিক করুন৷ আরো ভ্রমন কাহিনি পড়তে ভালোবাসলে পড়ুন ‘মাওলং’।