বৃষ্টিটা আজ আর থামবে না মনে হচ্ছে। শেষ হওয়া কফির কাপটা টেবিলে রেখে বিরক্তি প্রকাশ করল টলিপাড়ার উঠতি নায়িকা সুদক্ষিনা ব্যানার্জী। দুদিন সে স্যুটিং থেকে পেয়েছে বিরতি। পরশু ভোরে বেড়োতে হবে আউটডোরে। হাতে সময় ছিল বলে ভেবেছিল একটু কেনাকাটা করবে আর একবার মনি মাসির কাছে যাবে। গত দুদিন কাজের চাপে সময়ই হয়নি। আর আজ এই ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। যদিও ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিয়েছে সুদক্ষিনা। কি আর করবে, একবারে কাল সকালেই বাড়ি নিয়ে আসবে মনিমাসিকে সুদক্ষিনা। মনিমাসি ছাড়া বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগে, আপন বলতে তো ওই একটাই মানুষ আছে তার জীবনে। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে পড়ন্ত বারিধারায় চোখ রেখে ব্যালকনিতে ঝোলানো দোলনায় বসে সুদক্ষিনা । এমন এক একটা বিকাল তার স্মৃতির নদীতে ঢেউ তোলে। এমন’ই এক বৃষ্টিভেজা রাতে কোলকাতা শহরের রাস্তায় বেসামাল কিছু যুবকের গাড়ির চাকা পিষে দিয়েছিল তার বাবা সমরেন্দ্রকে। পুলিস কেসে তেমন সুবিধা হয়নি, কারন সমরেন্দ্র নিজেও ছিলেন নেশাগ্রস্ত। কত আর বড় হবে তখন সুদক্ষিনা ? বছর ছয়েক। ওই গাড়িটি সেই রাতে শুধু সমরেন্দ্রকে নয়, পিষে দিয়েছিল ছয় বছরের মেয়েটির সব আনন্দ। বদলে গিয়েছিল ওর গোটা জীবন। পরেরদিন সকালে যখন ময়নাতদন্তের পর দেহটি এসেছিল অতো বড়ো বাড়ির ভিতর দালানে, তখনো সুদক্ষিণা বুঝতোই না মৃত্যু কাকে বলে। তার বাবা ও মা’য়ের মধ্যে মিলের থে কে অমিল ছিল বেশি, এটুকু সে প্রায় রোজকার ঝগড়াঝাটি থেকে আন্দাজ করে নিয়েছিল। কিন্তু সেইদিন মা যেন পাথর সমান হয়ে গিয়েছিল।
সুদক্ষিনার জীবন কিন্তু এরপরও মসৃন ছিল না। সমরেন্দ্রর মৃত্যুর মাস তিনেক পর এক সকালে ঘুম থেকে উঠে সে জানল তার মা চলে গেছে, যদিও লোকে বলত পালিয়ে গেছে। চলে যাওয়ার আগে তার মা ময়ূরাক্ষী রেখে গিয়েছিল তাদের সর্বক্ষনের কাজের লোক মনির উদ্দেশ্যে একটা চিঠি ও ডায়রি। আর সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল কিছু টাকা- গয়না, আর ছোট্ট মেয়েটির শৈশব। প্রায় অনাথ ছোট্ট সুদক্ষিনা দেখেছিল একটু একটু করে আত্মীয়-স্বজনও আর তার খোঁজ রাখেনা। স্বার্থপর এই পৃথিবীটাকে চিনতে শিখল সে। তার পরিবার হয়ে উঠল মনিমাসি ও তার স্বামী রাখাল মেসো। নিঃসন্তান এই দম্পতি খুব যত্ন করে মানুষ করেছে সুদক্ষিনাকে। আজ সেই মনিমাসিই হাসপাতালে।
চারপাশের মানুষের চাহনি দেখে একসময় সুদক্ষিনা বুঝে যায় সে বেশ সুন্দরী। কলেজে পড়তেই মাথায় চাপল, অভিনয় করবে, মডেল হবে। এক গয়নার দোকানের মডেল হওয়ার প্রথম সুযোগটা পেতে তাকে খুব বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি। এখান থেকেই শুরু হয় তার পথচলা। ধীরে প্রশিক্ষণ নিয়ে, অনেক পরিশ্রম করে পাঁচ বছরে সে টলিপাড়ায় আপাতত নিজের জায়গা করে নিয়েছে। প্রথমে মনিমাসি একটু আপত্তি করেছিল, বলেছিল, “ওই দুনিয়াটা ভালো না, অনেকের বদনাম হয়।“ সুদক্ষিনা হেসে বলেছিল, “সেই ছোট থেকে কতো আর সুনাম শুনেছি গো? আর সাধারন দুনিয়াটা যদি এতো’ই ভালো হতো, তাহলে আমার শৈশবটা হারিয়ে গেল কেন?” আর আপত্তি করেনি মনিমাসি।
সাত মাস পর
আজ সুদক্ষিণা খুব খুশি। তার জীবনের প্রথম সিনেমার স্যুটিং শুরু আজ থেকে। সব অভিনেত্রীর’ই স্বপ্ন থাকে বড়পর্দায় অভিনয় করার। তাই এখন সে বৃন্দাবনে। আসার আগে মনিমাসি বলছিল, “আমার খুব ইচ্ছা একবার বৃন্দাবন যাওয়ার। নিয়ে যাবি?” এবারে না আনলেও ও ঠিক করে রেখেছে, একটু ব্রেক পেলেই মনিমাসিকে দু-তিন দিনের জন্য বৃন্দাবন নিয়ে আসবে। সকাল সাতটা থেকে প্রায় একটানা স্যুটিং এর পর সন্ধ্যায় হোটেলের উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠে সুদক্ষিনা। রাস্তার চারপাশ দেখছে আর ভাবছে পৃথিবীতে কত মানুষ অসহায়। একটু দুমুঠো অন্নের জন্য লোকের দানের অপেক্ষায় বসে থাকে। হঠাৎ সুদক্ষিণা চেঁচিয়ে উঠল, “থামো থামো, আরে ভাইসাব রুকো। একই গাড়িতে থাকা অপর এক অভিনেত্রী পারমিতা বলল, “কি হল? কিছু ফেলে এসেছো?” কিন্তু কথাগুলো সুদক্ষিণার কান অব্দি পৌঁছালো বলে মনে হলো না। কারণ ততক্ষনে সে গাড়ি থেকে নেমে ছুটেছে পিছনের দিকে। গাড়ির সামনের সিট থেকে ইউনিট ম্যানেজার প্রবাল সামন্ত দেখল, সুদক্ষিণা কোনো এক বৃদ্ধা ভিখারিনীর সামনে গিয়ে বসেছে। ভিখারিনী তার ভিক্ষাপাত্র সামনে এগিয়ে দিলেও সুদক্ষিণার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। আশপাশের মানুষজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভিড় জমাচ্ছে দেখে প্রবাল ডাকল, “এই সুদক্ষিণা” সুদক্ষিণা যেন চমকে উঠল। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দৌড়ালো গাড়ির দিকে।
হোটেল রাধা প্যালেসের ৩০৬ নং ঘরে সুদক্ষিণা পায়চারি করছে। সেই ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় ৩২ ঘন্টা। ঘড়ির কাঁটা বলছে পাঁচটা বাজে। এতক্ষনে তো প্রবাল দা’র ফিরে আসার কথা। সেই ভোর চারটেয় বেড়িয়েছে। তাহলে কি কাজটা করতে পারেনি? সুদক্ষিণা চাইছে না কেউ জানুক। কারণ মিডিয়া সারাক্ষন এদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, একটু চটুল কিছু পেলেই হলো। হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখল গাড়ির আলো।
ড্রাইভারের ফোন এল সাড়ে ন’টায়। ছ’টা থেকে ঘন্টা দুয়েক একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল সুদক্ষিণা। কাজটা প্রবাল দা যে এত নিঃশব্দে করে ফেলবে, সেটা ভাবেনি সুদক্ষিণা। যাইহোক এবার বেড়োতে হবে, কারণ কাজ ওর কাছে সবচেয়ে আগে। মনিমাসিকে ফোন করে জানাতে হবে, আগামিকাল না, আজ রাতেই সে কোলকাতা ফিরছে। অনেক কষ্টে সে এটার অনুমতি পেয়েছে। বিছানার দিকে তাকিয়ে একবার ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে সে বেড়িয়ে গেল।
রাত সাড়ে দশটায় প্লেন এসে পৌঁছালো দমদমে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ডাক্তারের রির্পোট নিয়ে উঠতে হয়েছে প্লেনে, কারণ উনি সুদক্ষিণাকে চিনতেই পারেননি। আচ্ছা উনি কি সুস্থ? রাত ১২টা নাগাদ ডোরবেলটা বাজাতেই দরজা খোলার আগেই মনি বলতে থাকে, “এতটা দেরি হবে আগে তো বলবি আর আমি চিন্তায়…” দরজা খুলে আর কথাটা বলতে পারেনি। মনিকে কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে দেখে চোখের জলের সাথে জড়িয়ে ধরে ময়ুরাক্ষী। সুদক্ষিণা তাদের পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, “আমি ফ্রেস হয়ে নি, তুমি ওনাকে ভিতরে নিয়ে যাও।“ মনে মনে ভাবল, নিজের
মেয়েকে চিনতে পারল না, অথচ কাজের লোক মনিকে ঠিক… অবাক লাগল সুদক্ষিণার। এখনো, এতকিছুর পরও ও অভিমান করে মানুষটার ওপর? নিজের ঘরে গিয়ে আর চোখের জলকে আটকাতে পারল না।
মনি বলছে,“ও তোমার মেয়ে গো বউমনি। ওকে চিনতে পারোনি? তোমার সেই ছোট্ট মাম্মম এখন সিনেমার নায়িকা গো। তোমার কথা আমি রেখেছি। সাধ্যমত ওকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। তবে তোমার মেয়ে খুব ভালো গো।“ দরজার আড়াল থেকে সুদক্ষিণা শুধু ওর মা’কে দেখে চলেছে। শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে ময়ুরাক্ষী বলল, “আর আমার মেয়ে। আমি মায়ের কোন্ দায়িত্ব আর পালন করেছি? প্রেমের নেশায় মেতে নিজের মেয়েকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কি পেলাম? জানো মনি, সমরেন্দ্রর ফুল দার কাছে যখন গিয়েছিলাম, সে আমায় ফিরিয়ে দিল। পরস্ত্রীকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। তার ওপর আবার বিধবা। তারপর কিভাবে যেন পৌঁছালাম বৃন্দাবনে। এখন আর সেকথা মনে নেই।“ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সবই আমার পাপের ফল। একদিন যাকে ফেলে চলে গেছিলাম, সে আমায় আজ রাস্তা থেকে নিয়ে এসে আমায় ঋণী করে দিল।“
আর শুনতে ইচ্ছা করল না সুদক্ষিণার। নিজের ঘরে এসে টেবিলে রাখা বাবার ছবিটা হাতে নিয়ে বলল, “উনি তো আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমি কেন পারলাম না বাবা ওনাকে পথেই ছেড়ে আসতে? আসলে উনি তো আমার মা, দেখেও কি করে ফেলে রেখে আসি বাবা? তবে আমি কি ওনাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব? মন থেকে মা বলে আর ডাকতে পারব? হয়তো না।“ বাবার ছবিটা বুকে জরিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল সে, যেমনটা কেঁদেছিল ছোটবেলায় মা চলে যাওয়ার দিন।
অনুলিপিতে আছে বেড়ানোর গল্প। পড়তে চাইলে ক্লিক করুন ‘ভ্রমনকথা’
অনুলিপির নতুন নতুন আপডেট পেতে চোখ রাখুন অনুলিপির ফেসবুক পেজে।