২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের এক শুক্রবার রাতে শিয়ালদহ পদাতিক এক্সপ্রেসে উঠে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ট্রেনের নাম শুনে অনেকেই বুঝে গেছে আমাদের গন্তব্য ছিল উত্তরবঙ্গ। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কোথায় তা ক্রমশ প্রকাশ্য। সফর সঙ্গী ছিল আমার স্বামী এবং তিন বন্ধু। ট্রেন রাতের অন্ধকার ভেদ করে আমাদের নিয়ে ছুটে চলল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বেড়ানোর আনন্দে, আবার পাহাড় দেখার আনন্দে, কয়েকটা দিন সব রুটিন ভুলে প্রকৃতির টানে ভেসে বেড়ানোর আনন্দে মন তখন নৃত্যরত। পরদিন সকাল ১০টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমেই বুঝলাম ঠান্ডাটা এখানে বেশ বেশী, তবে তখন অন্তত উপভোগ্য। আমাদের জন্য আগে থেকেই সেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল ড্রাইভার আকাশ। পাহাড়ী রাস্তার এক একটি বাঁক ঘুরে যত উপরে উঠছিলাম ততই মনে হচ্ছিল প্রথমে ঠান্ডাকে যতটা উপভোগ্য মনে হয়েছিল ততটাও মনোরম নয়। ছুটি কাটানোর জন্য আমরা এইবার বেছে নিয়েছিলাম ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম দাওয়াইপানি।
দাওয়াইপানি দার্জিলিং জেলার এক ছোট্ট গ্রাম। অফবিট বলে এখনো পর্যন্ত এই স্থানটির পরিচিতি কার্শিয়াং, কালিম্পং বা মিরিক- এর মতো না হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারন দৃশ্যমানতার কারনে বর্তমানে পর্বতপ্রেমী মানুষরা প্রায় সারাবছরই এখানে ভিড় জমায়। দার্জিলিং-এর বিখ্যাত পর্যটনক্ষেত্র টাইগার হিল- এর ঠিক বিপরীতের পাহাড়ে অবস্থিত এই পাহাড়ী গ্রাম, যার উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৬,৫০০ ফুট। দার্জিলিং শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি এবং নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে এর দূরত্ব ৭৬.৫ কিমি। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টায় আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম দাওয়াইাপানির ‘বিরেন রাই’ এর হোমস্টে’তে। পথে মোমো সহযোগে প্রাতঃরাশ সারতে গিয়ে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল।
উত্তরবঙ্গের অফবিট পর্যটন স্থান গুলির এক অন্যতম আকর্ষন হল হোমস্টেতে থাকার সুযোগ ও তাদের অনবদ্য আতিথেয়তা। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথে বিরেন বাবু আমাদের উত্তরীয় পরিয়ে স্বাগত জানালেন। আগে থেকেই আমাদের জন্য পরিপাটি করে সাজানো ছিল দুটি ঘর। ঘরগুলিতে অত্যাধুনিকতার ছোঁয়া না থাকলেও সৌন্দর্য ও যত্নের ছোঁয়া ছিল ভরপুর। ঘরের ঠিক বাইরের ফাঁকা লন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার যে অসাধারন সুদৃশ্যতা, তাতে ঘুম ব্যতীত ঘরমুখো হওয়ার সম্ভাবনা খুব’ই কম। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে নানারকম সুস্বাদু পদ সহযোগে মধ্যাহ্নভোজ সেরে পথের ক্লান্তি ভুলতে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।
পাহাড়ে সন্ধ্যা হয় কেমন অন্যরকম ভাবে। অনেকক্ষন আলো থাকার পর কেমন ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে, আর তার সাথে নেমে আসে শীতলতা। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আমাদের হোমস্টে-এর বামপাশে জ্বলে উঠল শতাধিক জোনাকি। না বাস্তবিক জোনাকি না, তবে দেখাচ্ছিল ঠিক তেমনই। আসলে ওটা দার্জিলিং শহর। সেই অসাধারন দৃশ্য যতটা মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল, ততটা হয়তো লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জানুয়ারির সেই রাতে জীবনে প্রথমবার ১ ডিগ্রি তাপমাত্রার শীতলতা অনুভব করেছিলাম। বুঝেছিলাম, রাত যত বাড়তে থাকে এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটা ততই শীতের চাদরে ঢেকে নেয় নিজেকে। তখন আমাদের মতো কোলকাতাবাসী দের জন্য গরম জামা ছাড়াও প্রয়োজন হয় ক্যাম্পফায়ার ও রুমহিটার। তবে বেড়ানোর আনন্দে পাহাড়ি শীতলতাও চাপা পড়ে যায়।
পরদিন ভোরবেলা সূর্যোদয়ের আগে ঘুম ভাঙতেই মনে হল, এমনই একটা সকালের প্রতীক্ষা আমার অনেকদিনের। ঘরের বাইরে পা রাখতেই গ্রাস করল একরাশ হিমশীতল বাতাস। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই সূর্যের প্রথম কিরণে স্বর্নময় হয়ে উঠবে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল উত্তেজনার চাপে। কে যেন কমলা রঙের তুলি বুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আকাশময়। টুপ করে লাল বলের মতো আকাশে দৃশ্যমান হল সূর্যদেব। তার সাথে সাথে এক এক করে যেন সোনায় মুরে যেতে লাগল কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের একাংশ। ঘুমন্ত বুদ্ধের ওপর পড়া সেই স্বর্নময় আলোকচ্ছটার অবর্ননীয় সৌন্দর্য আমাদের যেন উপহার স্বরূপ দিয়েছিল দাওয়াইপানির প্রথম ভোর।
দাওয়াইপানি থেকে ঘুরে দেখে নেওয়া যায় তাকদার বিখ্যাত অর্কিড উদ্যান, তিনচুলে বৌদ্ধ গুম্ফা, লামাহাট্টা ইকো পার্ক, পেশক চা বাগিচা, তিস্তা ও রঙ্গিত নদীর মিলনস্থল, যোগিঘাট ব্রিজ প্রভৃতি। আবার এখান থেকে রাত্রিবাসের জন্য কাছাকাছি কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যটন ক্ষেত্র হল তিনচুলে, রামপুরিয়া, শিটং, ছোটামাঙ্গুয়া, রেগারুন ও ভারতের অন্যতম শৈলশহর দার্জিলিং। দাওয়াইপানির মতো এই প্রতিটি জায়গা’ই তাদের নিজ নিজ প্রাকৃতিক সাজে অনন্য।
আমাদের মতো যদি কেউ পাহাড়প্রেমী হন, মাত্র দিন তিনেকের ছুটিতে সঞ্চয় করে নিতে পারেন এমন অসাধারন অভিজ্ঞতা।
দাওয়াইপানি ও তৎসংলগ্ন পর্যটনক্ষেত্র সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন নর্থবেঙ্গলট্যুরিসিম ওয়েবসাইট
ভ্রমনপ্রেমীদের জন্য আছে আমার আরো এক অসাধারন অভিজ্ঞতা জঙ্গলে রাত্রিবাসের। পড়তে চাইলে ক্লিক করুন জলদাপাড়ায় রোমাঞ্চকর রাত্রিবাস
One Reply to “পাহাড়রানী দাওয়াইপানি”