চোখের সামনে যেন এক টুকরো সুইজারল্যান্ড। ইউরোপের এই সুন্দর দেশটি সারা পৃথিবীর প্রায় সব ভ্রমনপিপাসু মানুষের ইচ্ছের ঝুলিতে স্থান পায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সুইজারল্যান্ড নামক এই স্বপ্নের দেশটি এখনো আমাদের কাছে অধরা। তাতে কি? আমাদের দেশ কম কিসে? যে জায়গায় পৌঁছে আমাদের এমন মনে হওয়া, সেই জায়গাটি হল কাশ্মীরের স্বল্প পরিচিত ভ্যালি বাইসরন। বেশ কিছু বছর আগে আমরা গিয়েছিলাম খাজ্জিয়ার। সেটি হল হিমাচল প্রদেশের সুইজারল্যান্ড। তার অপরূপ সৌন্দর্যেও আমরা মোহিত হয়েছিলাম। যাই হোক ফিরে আসি কাশ্মীরের সেই বাইসরন ভ্যালিতে।

বাইসরন - Beauty of Baisaranভোর ভোর উঠে নিগিন লেকের উপর ভাসমান হাউসবোটে থাকার শেষ আবেশটুকু মেখে যখন আমরা পহেলগাঁও এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম তখনও ভাবিনি এই ভ্যালি চাক্ষুস করার কথা। হাউসবোটের মালিকের কাছে এর সৌন্দর্যের কথা শুনলেও, তার কঠিন পথের কথা জেনে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারন, আমাদের সাথে যে একরত্তি মানুষটি আছে, তার বয়স মোটে দু বছর চার মাস। তাই আমাদের বেড়ানোর অতি উচ্ছ্বাসে ওর যেন বিশেষ কষ্ট না হয়, সেটা আমাদের মাথায় রেখে চলতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা যে ভ্রমনপাগল, সেটাও তো একটা বিষয়। তাই পহেলগাঁও পৌঁছে, তখন যত দেবদেবীর কথা মনে এসেছিল, সবাইকে স্মরন করে একটু রিস্ক নিয়েই ফেললাম। বার বার তো আর যাওয়া সম্ভব না, তাই মনকে প্রস্তুত করে আড়াই জনে উঠে পড়লাম দুটো পনির পিঠে। গন্তব্য বাইসরন ভ্যালি। পথের যে বর্ননা আমরা আগে পেয়েছিলাম, বাস্তবে তা আরো কঠিন। আসলে পথ বলে আমরা যাকে দাবি করছি, সেটা আদতে কোন পথ না, পাহাড়। প্রথমবার ঘোড়ায় চড়া আনাড়ি মানুষ হিসাবে আমরা শিখে চলেছি কি করে ঘোড়াকে আমাদের সহায়তা করা উচিৎ। কখনো নিজেদের সামনে ঝুঁকিয়ে, কখনো আবার পিছনে হেলে আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছিলাম। মনে মনে ঠাকুরকে স্মরন করে নিজের মনকেই প্রশ্ন করেছিলাম, খুব কি বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেললাম?কারন একবার ওই জায়গা থেকে পড়ে গেলে, সৌভাগ্যবশত প্রাণ যদি অক্ষত থাকেও, হাড় অক্ষত থাকার সম্ভাবনা অবাস্তব। আমরা বড়রাই বেশ ভয় ভয় পাচ্ছি, তো বুঝেই নিন, সাথের ছোট্ট মানুষটার অবস্থা। তার কান্না পথের চড়াই এর সাথে সাথে বাড়তে থাকে।বাইসরন - Way to Baisaran

যাই হোক ভয়ের কথা তো অনেক বললাম, এবার বলি ভয়কে জয় করে কি পেলাম তার গল্প। বাইসরন ভ্যালি পৌঁছে টিকিট কেটে যখন ভিতরে প্রবেশ করলাম, তখন ভয় আর শরীরের হালকা ব্যাথা ভুলে গিয়ে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছিল এক ছিলতে হাসি। মনে হচ্ছিল চোখের সামনে কেউ যেন রেখেছে সুইজারল্যান্ড এর পোস্টকার্ড ছবি। পথের ক্লান্তি ভুলে তখন মন বলেছিল, ভাগ্যিস একটু সাহসী হয়েছিলাম। আর যে ছোট্ট মানুষটি প্রায় পুরো রাস্তা কেঁদেছিল, সে মুক্ত গগনে যেন ভেসে চলেছিল। যত দূর পর্যন্ত চোখ যায়, শুধু সবুজের ঘনঘটা। সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে খাজ্জিয়ার এগিয়ে, নাকি বাইসরন, সেই তর্কে সময় অপচয়ের মতো বোকামি না করে আমরা শুধু প্রকৃতির নির্যাসটুকু নিতে ব্যস্ত ছিলাম। সময় যে বড়ই কম। কাশ্মীরকে সাজাতে ঈশ্বর যে কোনরূপ কার্পন্য করেননি, তা সবারই জানা। কিন্তু তার সৌন্দর্যের কিনারা বোধহয় সামনে না গেলে কল্পনা করা ও অনুভবব করা অসম্ভব। বাইসরন ভ্যালির সবুজায়নে চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। যে দিকে দু’চোখ যাবে শুধু সবুজ ঘাসের দেশ আর পাইন গাছের সারি। তবে শুধু প্রকৃতি দেখা’ই না, তাকে ঘিরে সুন্দর সুন্দর ভিডিও বানিয়ে, তা চিরদিনের জন্য নিজের কাছে সঞ্চয় করে রাখার সুযোগের সদ্ব্যবহার ও করা যায় সেখানে। আর তার জন্য সেখানে অনায়াসে পাওয়া যায় দক্ষ ভিডিওগ্রাফার। পকেট ভর্তি থাকলে যে কেউ তার সোস্যাল মিডিয়াতে ‘রিল’ এর তালিকা বাড়িয়ে নিতে পারে। আর কাশ্মীরী পোষাকে সুসজ্জিতা হয়ে ছবি তোলা তো কাশ্মীরের প্রতিটি জায়গায় এক উল্লেখযোগ্য ব্যবসা। তবে এই ভ্যালিতে আমরা দুটোর কোনটাই করিনি। কারন ঘোরা তো সবে শুরু,কাশ্মীর তো আভি বহুত বাকি হ্যায়। তবে হ্যাঁ, নিজেদের মুঠোফোনে মুহুর্তগুলো বন্দি করতে আমরাও যে তৎপর ছিলাম, তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যে কারোর জন্য, কিছুর জন্য একটুও থমকায় না। তাই মন না চাইলেও আমার সঙ্গীটিকে বলতে হয়েছিল, “চল এবার ফিরে যাই।“

বাইসরন - Natural Beauty of Baisaranচড়াই এর পথ বন্ধুর হলেও নির্বিঘ্ন ছিল। উৎরাই এর পথও সহজ না সে তো জানাই ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটার আশঙ্কা কে আর মনে মনে করে? তবে ঘটনাবহুল সফর কিন্তু মনে থেকে যায় বেশি। তখন আমরা বেশ কিছুটা পথ পেড়িয়ে পাহাড়ের নীচের দিকে নেমে এসেছিলাম, হঠাৎ ছোট্ট ঘোড়াটি আর এগোতে পারছিল না, যার পিঠে আমি বসে ছিলাম। তার একটি পায়ের খুড় দুটো পাথরের মাঝে আটকে গিয়েছিল। মনে মনে ভাবছি, এবার যদি পায়ে হেঁটে নীচে নামতে হয়? এমন নয় যে আগে কখনো পাহাড়ি পথে পা চালাইনি, কিন্তু এখন যে সাথে আছে এক ছোট্ট মানুষ। তাকে কোলে নিয়ে নামা একটু দুষ্কর তো বটেই। কিন্তু না, তেমন কিছু করতে হয়নি। বেশ কিছুক্ষন টানাটানিতে যখন খুড় টা খুলল ছোট্ট ঘোড়াটি আবার আমাকে নিয়ে নামতে লেগেছিল পাহাড়ের গা বেয়ে। আর তার পিঠে বসে আমার শুধু মনে হচ্ছিল, আমাদের বেড়ানোর আগ্রহের জন্য, আর ঘোড়াওয়ালার রোজগারের জন্য আমরা এই নিরীহ পশু গুলোর ওপর কতো অত্যাচার করি। যাই হোক বাকি পথে কোন সমস্যা হয়নি। ফিরে এসে আমরা মনে মনে বলে ভাগ্যিস একটু সাহসী হয়েছিলাম।

ভ্রমনকথা এমন এক গল্প যা শুনলে মনে হয়, এই তো ঘুরছি। তাই অনুলিপিতে আছে ‘পাহাড়রানী দাওয়াইপানি’। পড়ে দেখতে পারেন, আশা করি ভালোবাইসরন - Pine trees in Baisaran লাগবে।

বাইসরন ভ্যালি সম্পর্কে আরো কিছু জানার থাকলে অনুলিপির ইন্সটাগ্রাম পেজে ক্লিক করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *