আলিপুর ন্যাশানাল লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে আর কিছু যেন খুঁজছে ঋতম। “আপনি?” অচেনা স্বরে পিছন ফিরে তাকাল। সেই রেস্টরেন্ট থেকে চলে যাওয়ার পর এই প্রথম দেখল মেঘাশ্রীকে। মাঝে কেটে গেছে প্রায় এক মাস। একটা আলাদা ব্যাপার আছে মেয়েটির মধ্যে, দেখতে সাধারন হলেও ভিড়ের মাঝে মনে থাকার মতো চেহারা। তাই হয়তো বাবার’ও এত পছন্দ হয়েছে। যদিও বাবা আজকাল আর বিয়ে নিয়ে কিছু বলে না। “ঋতমবাবু?” আবার ডাকল মেঘাশ্রী। চোখ নামিয়ে নিল ঋতম, মনে মনে ভাবল এমন ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকাটা ঠিক না। অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “আরে আপনি এখানে?” মেঘাশ্রী একটু হেসে বলল, “আমার ইউনিভার্সিটির সামনে আমি তো আসতেই পারি, কিন্তু আপনি কি এখানে কোনো কাজে এসেছেন?” ওই এক চিলতে হাসিতে মন আটকে যায় ঋতমের। মেঘাশ্রী চোখ নামিয়ে বলে, “উত্তরটা কিন্তু পেলাম না।“ ঋতম অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “হ্যাঁ ওই আর কি, একটু কাজ ছিল।।“ মেঘাশ্রী মজার ছলে প্রশ্ন করল, “কোথায় কাজ ছিল? ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে নাকি আলিপুর চিড়িয়াখানায়?” ঋতম একটু চাপা গলায় বলল, “যদি বলি আপনার কাছে?” মেঘাশ্রী এক পলক তাকিয়ে বলল, “আমি আসি, আমার পরীক্ষা আছে। দেরি হয়ে যাবে।“ ঋতম ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে বলল, “best of luck টা তো বলতে দিন।“ মনে মনে বলল জানি তো পরীক্ষা, তাই তো এখানে আসা। চলে যেতে গিয়েও ফিরে তাকাল মেঘাশ্রী। ঋতমকে ডেকে বলল, “আপনি কি আমার সেদিনর বলা কথাগুলো কিছুই আপনার বাবাকে বলেন নি?” ঋতম অবাক হয়ে বলল, “কেন বলুন তো?” মেঘাশ্রী বলল, “আপনি জানেন কি না জানি না আপনার বাবা কিন্তু এখনো আমার মামার সাথে প্রায়’ই যোগাযোগ রাখে ফোনে। আমার খোঁজ খবর ও নেয়। ঋতম নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন করল, “তো?” মেঘাশ্রী ভ্রু কুঁচকে ঋতমের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না, উনি হয়তো আমার-আপনার বিয়ের আশা করে আছেন। ওনার আশাভঙ্গ হলে উনি মনে মনে আঘাত পাবেন।“ ঋতম জিজ্ঞাসা করল, “আমার বাবা কি আর বিয়ে নিয়ে কিছু বলেছে?” মেঘাশ্রী চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, “না, তা বলেন নি। তবে…” মেঘাশ্রীকে শেষ না করতে দিয়ে ঋতম বলল, “তবে ছাড়ুন। হতে পারে দুজনের বন্ধুত্ব হয়েছে। আপনি বরং বিয়ের চিন্তা ছেড়ে, পরীক্ষায় মন দিন।“ “আমি বিয়ের চিন্তা করি না।“ বিরক্তি সহকারে কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না মেঘাশ্রী। মনে মনে ভাবল ঋতম, ভাগ্যিস বাবা যোগাযোগ রাখে, তাই না আজ তোমার দেখা পেলাম।
মাস আটেক পর
আপনি এখন পরিনত হয়েছে তুমি’তে, পরিচয় বদলেছে ভালোবাসায়, মাঝে মধ্যে দেখা করার জন্য রেস্তোরা কিংবা শপিং মল হয়ে উঠেছে গন্তব্য। প্রিয়ব্রতর অগোচরে গড়ে উঠেছে মেঘাশ্রী আর ঋতমের সম্পর্ক। অবশ্য উনি এখন আর ছেলের বিয়ে নিয়ে কোনো উন্মাদনা’ই দেখান না, সবটাই ছেড়ে দিয়েছেন ছেলের ওপর। তবু মেঘাশ্রী মেয়েটার জন্য মনের মধ্যে একটা মায়া থেকে গেছে। শনিবার, অফিসের শেষে মেঘাশ্রীকে নিয়ে রেস্তোরায় ঢোকে ঋতম। আজ একটা বিশেষ দিন, মেঘাশ্রীর জন্মদিন। কিন্তু সাথে থেকেও যেন নেই সে। আজ যেন মেঘাশ্রীকে কেমন অন্যরকম লাগছে। ঋতম ওর হাতে আলতো করে চাপ দিতে মেঘাশ্রী মাথা রাখল ঋতমের কাঁধে। একটু কি কেঁপে উঠল ঋতম? কারন এই প্রথমবার মেঘাশ্রী ওর এত কাছে এল। উপহার স্বরূপ একটা ‘M’ লেখা ছোট্ট সোনার লকেট এনেছে, কিন্তু এখনো দেওয়ার সুযোগ পায়নি মেঘাশ্রীকে। যদিও ওর শর্ত ছিল কিছু আনতে পারবে না সাথে, তবুও শর্ত ভঙ্গ করে। ওই যে কথায় আছে, ভালোবাসা ও যুদ্ধে সব চলে। ঋতম উপহারটা দিতে যাবে তার আগেই মেঘাশ্রী বলল, “মাঝে মাঝে ভাবি আজ আমার মা থাকলে কেমন হতো আমার জীবন? হয়তো তোমার মা শুরুতেই আমায় নাকচ করে দিতেন না। হয়তো আরো কত কি হতে পারত। ঋতম বলল, “আরে মা’কে আমি ঠিক মানিয়ে নেব, তুমি মন খারাপ করো না।“ মেঘাশ্রী বলল, “না না আমি এমনি বললাম কথাটা। হয়তো এমনটা হতো। ঋতম আমি তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।“ বলে একটা মুখবন্ধ খাম ঋতমের হাতে দিল। হালকা হেসে ঋতম বলল, “এটা কি? লাভলেটার?” “আমার মায়ের চিঠি।“ মেঘাশ্রীর হিম শীতল গলা মুহুর্তে ঋতমের মনের সব আলো নিভিয়ে দিল। মেঘাশ্রীর দুচোখে জলের ধারা। “মা আমার জন্য এই চিঠিটা রেখে গিয়েছিল, মামা এটা আমায় অনেক বছর আগেই দিয়েছিল। কিন্তু আমি কোনোদিন খুলে দেখিনি। একরাশ অভিমান ঋতম। তুমি’ই বলো, সেটা কি ভুল?” ঋতম জানে কোনো উত্তরের আশায় সে প্রশ্নটা করেনি, আর এই মুহুর্তে মৌনতাই শ্রেয়। মেঘাশ্রী নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমি চাই চিঠিটা তুমি পড়ো, আমার কিছু জানার আগ্রহ নেই। “ঋতম মেঘাশ্রীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, আজ এসব থাক। আর যা জানার তোমার কোন আগ্রহ নেই, আমি জেনে কি করবো? তোমাকে তো জানি, সেটাই যথেষ্ট।“ বলে খামটা এগিয়ে দিতে গিয়েও মেঘাশ্রীর করুন চোখের দিকে তাকিয়ে পারলো না। খামটা ধীর হস্তে খুলল। চিঠিটা হাতে নিয়ে একবার তাকালো মেঘাশ্রীর দিকে, সত্যি বলতে সন্ধ্যাটা যে এমন কাটবে তা একবারও ভাবেনি ঋতম। পড়তে শুরু করল-
‘আমার সোনা মেয়ে,
যখন তুমি এই চিঠিটা পড়বে, তখন আমি তোমার কাছে থাকব না। তার জন্য পারলে আমায় ক্ষমা করো। আসলে হয়তো আমি স্বার্থপর, হয়তো সাহসের খুব অভাব। Sorry মা। তবে আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।‘- ঋতম একবার তাকাল মেঘাশ্রীর দিকে। মেঘাশ্রীর চোখ অন্যদিকে। ঋতম বলল, “তুমি পড়ছো না?” মেঘাশ্রী মাথা নীচু করে বলল, “আমি নতুন করে আর কিছুই জানতে চাই না, শুধু তোমার আর মা-এর মধ্যেই থাক। তুমি পড়ো।“ ঋতম আবার পড়া শুরু করে।
‘ তোমার যিনি বাবা, তাঁর সাথে আমার পরিচয় চাকরিসূত্রে। জলপাইগুড়িতে আমরা একসাথে কাজ করতাম। দীর্ঘ, সুপুরুষ চেহারা, কথার জাদুতে সহজেই সবার মন জয় করতে পারা মানুষটাকে খুব কম দিনেই ভালোবেসে ফেলি আমি। কিন্তু উনি কোনদিন আমায় আলাদা করে গুরুত্ব দেননি। তবু এই একতরফা ভালোবাসা বাড়তেই থাকে। উনি আমায় স্নেহ করতেন ঠিকই, কিন্তু ভালো হয়তো বাসেননি। তবু একটা সন্ধ্যায় সব কেন জানি ওলট পালট হয়ে গেল। তারপর আর আমাদের কখনো দেখাই হল না। হয়তো উনি লজ্জায় আর আমার সামনে আসেন নি, জানেও না হয়তো তোমার জন্মের কথা। আমার ও যে বড় কুন্ঠাবোধ। কারন আমি পরে জানতে পারি উনি বিবাহিত। কিছু ভুল হয়তো সংশোধন করার উপায় থাকে না। আমার কাছে তার একটি মাত্র ফটো আছে, রেখে গেলাম তোমার জন্য।
ইতি’…….
ঋতম খাম থেকে ছবিটা হাতে নিতেই কৌতুহল বশত চোখ তুলল মেঘাশ্রী।
কেমন ছিল ঋতম ও মেঘাশ্রীর প্রথম সাক্ষাৎ? মধুর? নাকি ছিল শুধুই তিক্ততার? যদি জানা না থাকে তাহলে চটপট পড়ে ফেলুন শেষ বলে কিছু নেই- পর্ব দুই।
শুধু ওয়েবসাইট নয়, আপনারা আরো অতিরিক্ত কিছু লেখা পেতে ও অনুলিপির আপডেট পেতে ফলো করুন ইন্সটাগ্রামে।