গল্প হলেও সত্যি, বা বলা যায় সত্য ঘটনা অবলম্বনে ৷ ২০১৯ সালের মার্চ মাসের এক রাত ৷ শীত তখন সমতলকে বিদায় দিয়ে পাহাড়ের কোলে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে ৷ ঘড়ির কাঁটা তখন আট টার ঘর ছোঁবো ছোঁবো করছে, আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে জঙ্গলেরর বুক চিরে । গাড়িতে ড্রাইভার সহ আমরা মোট ৬ জন ছিলাম। গুগল ম্যাপের ভরসায় আমরা খুঁজে চলেছি আমাদের রাত্রিবাসের ঠিকানা ‘সিসামারা রাইনো কটেজ।
ডুয়ার্সের জলদাপাড়া অভয়ারন্যের বেশ অনেকটা ভিতরে ফালাকাটা থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই রাইনো কটেজ। কটেজের বর্ননার থেকেও বেশি আকর্ষনীয় আমাদের কটেজ খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা।
চারিদিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার, আকাশে মেঘের গর্জন, জনমানবহীন গহন জঙ্গলে শুধু শোনা যায় ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। এদিকে গুগল ম্যাপ জানিয়ে দিচ্ছে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, কিন্তু কোথায় রাইনো কটেজ? চারিদিকে শুধু বড় বড় গাছের সারি আর অন্ধকার, যাকে দূর করার বৃথা চেষ্টা করছে গাড়ির হেডলাইট। মনে হল সেই রাতটা বোধহয় জঙ্গলেই কাটাতে হবে, কারন মোবাইলের নেটওয়ার্কের অবস্থা তথৈবচ। ভয়মিশ্রিত উত্তেজনায় তখন আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। বহু চেষ্টার পর ফোনে যোগাযোগ করা গেল, কটেজ এর মালিক বললেন, উনি আসছেন আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু আমরা যেন সবাই গাড়ির ভিতরেই থাকি, কারন মেঘের ডাক শুনে যে কোন মুহুর্তে হাতির পাল বেড়োতে পারে। সে এক রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। যে কোন রকম শব্দকে’ই হাতির পায়ের শব্দ বলে মনে হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা মনে হচ্ছে থমকে গেছে। বেশ কিছু সময় পর একপ্রকার আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন এই রাইনো কটেজ এর মালিক মিঠুন সরকার।
ফিরতি পথে আসতে গিয়ে বুঝলাম আমরা রাইনো কটেজ ছাড়িয়ে জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে চলে গিয়েছিলাম। তখন প্রায় রাত ন’টা বাজে। রাতের অন্ধকারে সব ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না। সেই সকাল ৯টা থেকে ঘুরে, তারপর কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনার ধকলে ক্লান্ত শরীর ও মন তখন চাইছে গরম গরম চা। মনের ইচ্ছা কখনো কখনো মুখ দেখে বোঝা যায়, তাই বোধহয় মিঠুন বাবু আমাদের হাত ধুয়ে চা খেয়ে ঘরে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। খাবার ঘরে গিয়ে বুঝলাম অভিনবত্বের অনেক কিছুই এখানে পাওয়া যাবে। এখানে সব টেবিল ও চেয়ার বানানো গাছের গুড়ি কেটে। চা খেতে খেতে এখানকার নানা রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনছিলাম মিঠুন বাবু ও তার দু’জন বন্ধুর থেকে। ওনাদের তরফ থেকে রাতের অন্ধকারে একটু জঙ্গল ভ্রমনের প্রস্তাব পেয়ে আমাদের কয়েকজনের মন নেচে উঠল নতুন কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আকাঙ্খায়, ঘরে বসে থাকার জন্য তো আর বেড়াতে যাই’নি। বন্যপ্রানীদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য পুরো কটেজ এরিয়া উঁচু পিলার ও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, কয়েকটা সিঁড়ি ও ছোট একটা গেট পেরিয়ে যে রাস্তাটায় উঠলাম তাকে বলে Animal Corridor বা পশু চলাচলের রাস্তা,যদিও সেই রাতে আমরা প্রায় সাতজন মিলে হেঁটে চলেছিলাম জঙ্গলের দিকে। আমাদের পদচিহ্নের আগে থেকেই সেখানে ছিল হাতির পদচিহ্ন। বুঝলাম যে সময় আমরা জঙ্গলের মাঝে দিশেহারা হয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, হস্তি মহাশয় তখন এই পথে সান্ধ্যভ্রমন করছিলেন। তবে তার দুলকি চাল দেখার সৌভাগ্য আমাদের হল না।চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ভরসা সবার মোবাইলের টর্চ। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, আমরা যে পথে চলেছিলাম তা জঙ্গলের পথ নয়, জঙ্গল সেখান থেকে হাত দশেক দূরে একটা সরু নদীর ওপারে। কিছুটা এগিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আমি থমকে গেলাম, একটু দূরেই নদীর পাড়ে যেন দুটো টুনি বাল্ব জ্বলছে। মিঠুন বাবুকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওটা আসলে বাইসনের চোখ, এবং সাথে সাথে উনি এটাও জানালেন যে, আমরা যেন প্রস্তুত থাকি। কারন ওই চোখের জ্যোতি যদি এগোতে থাকে, তাহলে আমাদের যত দ্রুত সম্ভব কটেজের ভিতর পৌঁছে যেতে হবে, কারন বাইসন কিন্তু মানুষের থেকে ভালো দৌড়বিদ। ভাগ্যক্রমে তেমন কিছু হয়নি। তবে আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়েছিল হাতির হঠাৎ আগমন থেকে। ভয়ে যে একটুও বুক কাঁপেনি তেমনটা নয়, তবে অ্যাডভেঞ্চারের নেশার পারদ সেই ভয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল। কোথা দিয়ে যেন সময় পেড়িয়ে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ন’টায় পৌঁছে গিয়েছিল। এবার ঘরে যেতে হবে।
একটু কটেজের বিবরন তো এবার না দিলেই নয়। রাতে এই কটেজকে যেমন নিঃসঙ্গ মনে হয়, দিনের আলোয় জায়গাটা ততটাই মনমুগ্ধকর। লোহার পিলারের ওপর দুটো করে ঘর, সাথে লাগোয়া লম্বা বারান্দা। বন্যপ্রানীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এমন ব্যবস্থা। চারিপাশ গাছগাছালিতে ভরা। অরন্যের একটু টুকরো পর্যটকরা কটেজে বসেও উপভোগ করতে পারবে। এখানে পর্যটকেদের সুবিধায় সদা তৎপড় স্থানীয় এক পরিবার। তাদের আতিথেয়তা ও সুস্বাদু ঘরোয়া খাবার আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছিল। নিঝুম রাত্রি যেন এখানে সত্যি’ই রোমাঞ্চকর। রাতের নির্জনতা ভেদ করে যখন কানে ভেসে আসে হাতির কর্কশ ডাক তখন মনে এক অন্যরকম শিহরন সৃষ্টি করে।কোনো ঘড়ি বা মোবাইলের যান্ত্রিক শব্দ না, এখানে সকালে ঘুম ভাঙবে নানা পাখির কলতানে, এক দৌড়ে বারান্দায় এসে সেইসব ঘুম ভাঙানো পাখিদের খুঁজতে গেলে সম্পূর্ন সফল হওয়ার সম্ভবনা কম। তবে হঠাৎ করে দেখা মিলতে পারে কোন হরিণ শাবকের, যেমন আমি পেয়েছিলাম জল খেতে আসা এক ছোট্ট হরিণের দেখা। সন্ধ্যায় ঠান্ডার আমেজ গায়ে মেখে অনেকে মিলে ক্যাম্প ফায়ার বা নেহাতই সবুজের মাঝে থেকে মনকে একটু সতেজ করে নেওয়া, ভ্রমনে যেন একটা আলাদা মাত্রা আনে। ডুয়ার্স ভ্রমনের রাইনো কটেজে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা আমার কাছে তাই চিরস্মরনীয়।
ডুয়ার্স ভ্রমনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত পর্যটন স্থান হলো জলদাপাড়া। এছাড়াও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান হলো – গরুমারা, চিলাপাতা, বক্সা, টিয়াবন। আর যদি জঙ্গল ছেড়ে যেতে চান পাহাড়ে, তাহলে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন লাভা, রিশপ, ঝান্ডি’র মতো মনোরম স্থানে।
আমার এই ভ্রমনকথা পড়ে আপনাদেরও যদি ইচ্ছা হয় এমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের, তাহলে অবশ্যই ক্লিক করুন যোগাযোগ।
জলদাপাড়া বেড়ানোর পরিকল্পনা করলে অবশ্যই এক – দু দিন কাটিয়ে নিতে পারেন সবুজের মাঝে এই রাইনো কটেজে। আরো বিস্তারিত জানতে লগ ইন করুন রাইনো কটেজ অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ
One Reply to “জলদাপাড়ায় রোমাঞ্চকর রাত্রিবাস”