রাজবাড়ী তে রাজা সাজতে আর কার না ভালোলাগে? সেই সুযোগ পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছা করে না। বাঙালি মানেই ভ্রমনপ্রেমী, একদিনের ছুটি ও মনে হয় অনেক। আমরাও তাই বেড়িয়ে পড়েছিলাম একটা অন্যরকম দিনযাপনের জন্য। একটি রাতের অতিথি হতে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ইটাচুনা রাজবাড়ী। যদিও পরে জেনেছিলাম, আসলে ওটা জমিদারবাড়ী। সে যাই হোক, হুগলী জেলার এই দ্রষ্টব্য এককথায় অসাধারন। বেশ একটা রাজকীয় ব্যাপার। হাওড়া থেকে বর্ধমানগামী মেন লাইনের এক লোকাল ট্রেনে চেপে পৌঁছে গিয়েছিলাম খন্নান স্টেশনে। এখান থেকেই যেতে হয় রাজবাড়ী। গতবছর ১৬ই সেপ্টেম্বরের তপ্ত দুপুরে স্টেশন থেকে বর্তমানের অন্যতম জনপ্রিয় যান টোটোতে চড়ে আমরা গুটি গুটি এগিয়ে চললাম। রাজবাড়ীতে ঢুকতেই কেমন যেন এক ভালোলাগার আবেশ জন্মালো মনে। প্রথম যে ঘরে গেলাম সেটি বিশ্রাম কক্ষ এবং বিক্রয়শালা। এক প্রতিবন্ধী সংস্থার নানান হাতের কাImage of Itachuna রাজবাড়ী Front View   জের কিছু জিনিস আপনি চাইলেই কিনে নিয়ে যেতে পারেন। ঘরে যাওয়ার আগে অফিসে নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হয়েছিল। এই নিয়ম সর্বত্র সমান। রাজবাড়ীও তার ব্যতিক্রম নয়। এই রাজবাড়িটি বর্তমানে Mylestones & Journeys নামক এক সংস্থা পরিচালনা করেন। প্রাসাদের মাত্র ১২টি ঘর এই কোম্পানিকে লিজ দেওয়া হয়। পরিবেশ যতই রাজকীয় হোক, প্রযুক্তি কিন্তু আধুনিক। তাই আমরা ওয়েবসাইট থেকে আগেই বুক করেছিলাম বড়মা’র ঘর। এখানে রকমারি নামে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ঘর আছে। হয়তো তৎকালীন সময়ে বড়মা থাকতেন এই ঘরে, যা একদিনের জন্য আমাদের। বেশ সুসজ্জিত এক দালানের পর বড়মা’র ঘর। সাবেকি ও আধুনিকতার এক অনন্য মেলবন্ধন। ঘরে পালঙ্ক, শ্বেতপাথরের টেবিল, কড়ি বরগা প্রভৃতির যেমন দেখা মিলবে, তেমনি এসি, গিজার, বৈদ্যুতিক কেটলি সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক পরিষেবার অভাব নেই। এককথায় অত্যাধুনিক রাজকীয়তা। আমরা ছিলাম অন্দরমহলে। কারন তৎকালীন সময়ে বাড়ির মহিলাদের জীবন ছিল অন্দরমহলেই সীমিত। স্নান সেরে এবার একটু ঘুরে দেখার পালা। সময় যে একদম বেঁধে দেওয়া। পরের দিন প্রাতঃরাশ সেরেই, সঙ্গে নিয়ে ঝোলা, বাড়ির পথে চলল ভোলা- বলে বেড়িয়ে পরতে হবে। আমাদের ঘরের ঠিক পাশে মেজমা’র ঘর। আর উঠানে এসে সামনে বৈঠকখানা, আর ডানপাশে দাবা ঘর। সেটাও দেখার মতো। এত বড়ো দাবার ঘুঁটি আমি আগে কখনো দেখিনি। ঘরটিকে প্রায় তৎকালীন সময়ের মতো করেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অন্দরমহল থেকে বাইরে বেড়োলেই নাটমন্দির আর বিশাল প্রাঙ্গন। এই জায়গাটির ছবি দেখে আসার আগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল আমার। এখানে সকালের চা ছাড়া অন্য কোন খাবার ঘরে পরিবেশনের নিয়ম নেই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য। তাই এবার খাবার ঘরে যাওয়ার পালা। সেখানে

Image of delicious lunch served in Itachuna রাজবাড়ীজমিদার শ্রীমান দেবনারায়ন  কুন্ডু’র বিবাহ উপলক্ষে যে খাদ্যতালিকার ছবি আছে তা শুধু রকমারি তাই নয়, বিশাল ও। প্রায় ৬৪- ৬৫ রকমের পদের নাম আছে। অবশ্য জমিদারদের বিয়ে বলে কথা।

এবার আসি আমাদের মধ্যাহ্নভোজের কথায়। আহা এমন থালা, বাটিতে সাজিয়ে খাবার পরিবেশন করলে খাওয়ার ইচ্ছাটাও যেন বেড়ে যায়। সাবেকি পিতলের থালা- বাটি- গ্লাস, সাথে উচ্ছে চচ্চড়ি, ডাল, ঝুরো আলুভাজা, বড়ি দিয়ে লাউঘন্ট, লুচি, বাঁধাকপির তরকারি, মাছভাজা, পাঁঠার মাংস প্রভৃতি নানান সুস্বাদু পদ সামনে সাজানো থাকলে হাত ও মুখ কি আর অপেক্ষা করতে পারে? তবুও স্মৃতির খোরাক হিসাবে সব ক্যামেরাবন্দি করাও আবশ্যক। প্রধান রাঁধুনি প্রভাতীর হাতের রান্না ভালোই, তবে নিরামিষ পদগুলি বেশি ভালো।

রাজবাড়ির শান্ত, নির্জন বিকালে এবার সমগ্র বাড়িটি ঘুরে দেখার পালা, আর গাইড এর কাছে শুনতে থাকা এই বাড়ির নানা ইতিহাস। নাটমন্দিরের সামনের চাতাল থেকে শুরু হল রাজবাড়ি ভ্রমন। রাজবাড়ীর পিছনের পুকুরে তখন মিশে গিয়েছে পড়ন্ত সূর্যের নিস্তেজ আলো। আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা কুটির গুলোর নামকরন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। প্রতিটি কুটিরের নাম এক একটি ফুলের নামে। যেমন কনকলতা, ঝুমকোলতা, মাধবিলতা, অপরাজিতা। শুধু ফুলের নামে নামাঙ্কিত তাই নয়, প্রতিটি  কুটিরের সামনে যে ফুলের গাছ, সেই কুটিরের সেই নাম।

Itachuna Rajbari in eveningকত সুন্দর শৈল্পিক ভাবনা। ছাদ থেকে যখন পুরো রাজবাড়ীটা দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল চোখের সামনে কোন ছবি মেলে ধরা। তারপর সন্ধ্যার আলো আধাঁরিতে গোটা রাজবাড়ি আলোকময় হয়ে উঠল, সত্যি সে কি সুন্দর দৃশ্য। এবার নাটমন্দিরে সন্ধ্যা আরতি দেখার পালা। অন্ধকারের মাঝে আলোকজ্জ্বল নাটমন্দিরটি দেখতে অপূর্ব লাগছিল। একদিনের জন্য এখানে কিন্তু অনেক চমক আছে। আছে এক বাঁশিওয়ালা। নিঝুম সন্ধ্যা,

Image of "Natmandir" in evening in Itachuna Rajbari

রাজকীয় পরিবেশ, মশলা মুড়ি সাথে মনমাতানো বাঁশি- এমন এক সন্ধ্যা কি কখনো ভোলা যায়? হয়তো না।

রাজার বাড়ীতে রাত্রি নেমেছে। নিস্তব্ধ আঁধারে মনে যে অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এইসব বংশের ইতিহাসে থাকে কত শত অলৌকিক কাহিনি। তার ওপর আবার গাইড বাড়িটি ঘুরে দেখানোর সময় আস্তাবলের কাছে এমন একটি জায়গা দেখান যেখানে তৎকালীন সময় মানুষদের মেরে পুঁতে দেওয়া হত। এই বাড়িটি নতুন করে সাজিয়ে তোলার সময় এমন বহু কঙ্কালের অংশ পাওয়া গিয়েছিল। যদিও জানিনা এগুলো সত্যি নাকি ইতিহাস রক্ষার জন্য বানানো, তবু  নিস্তব্ধ এতোবড়ো রাজবাড়িতে যখন রাত গাঢ় হয় একটু ভয় তো লাগতেই পারে। কিন্তু ভয়টাও বেশ উপভোগ্য ছিল। এখানে রাত্রিকালীন আহার শেষ করতে হয় রাত ১০টার মধ্যে। এনারা খাবার পরিবেশনে অত্যন্ত যত্নবান। পিতলের থালায় রুটি, দুরকম তরকারি, মুরগির মাংস, মিষ্টি সহ ভোজনটা ছিল বেশ তৃপ্তিময়। পরিবেশ বেশ ভৌতিক হলেও ভূতের দেখা যে মেলেনি এই অনেক। মনে সান্ত্বনা স্বরূপ ছিল গাইডের বলা একটি বাক্য- যে বাড়ির মাঝখানে দেবতা বিরাজ করে সেই বাড়ীতে কখনো অপদেবতা থাকতে পারে না।

Image of one of the heritage destination near Kolkata - "Itachuna Rajbari"ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘুম ভাঙা, সেই উষ্ণ চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুনতে থাকা বাঁশিওয়ালার সুরেলা বাঁশি, সাথে নানান পাখির ডাক- এমন সিনেমার মত সুন্দর সকাল কে না চায়? সত্যি সকালটা তেমনই ছিল। তবে এবার ফেরার প্রহরও উপস্থিত। লুচি, তরকারি, মিষ্টি সহযোগে প্রাতঃরাশ সেরে শেষবারের মত রাজবারির পরিক্রমা করে রাজা সাজার পালা সাঙ্গ করে এবার বাড়ির পথে পা বাড়ানোর সময়। সাথে ছিল আবার রুটিন মাফিক জীবনে ফেরার হালকা দুঃখ, আর একরাশ রাজকীয় স্মৃতি।

আমি কিন্তু আরও অনেক বাঙালির মতোই ভ্রমনপ্রেমী। তাই আরো কিছু এমন অভিজ্ঞতার কথা পড়তে ক্লিক করুন ভ্রমনকথা

আপনারাও যদি হাতের কাছে এমন রাজকীয়তা পেতে চান, তাহলে মাত্র একদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন। আর তার জন্য নিজের মনের মতো ঘর বুক করে নিতে পারেন রাজবাড়ির  নিজস্ব ওয়েবাইট থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *