Own Drawing of a solitary person “কোন দিকে গেলে যেন কোনা এ‍‌ক্সপ্রেসওয়ে যাওয়া যায়?” গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে একটু ভাবতে লাগল সংকলন। প্রায় ১২-১৩ বছর হয়ে গেল এইদিকে আসা হয়নি। অবশ্য শেষ ২০ বছরে কোলকাতার আর কোন্ দিকটাই বা গেছে ও। সংকলন এখন দুবাইতে থাকলেও এই কোলকাতা শহরটা এখোনো তাকে চুম্বকের মতো টানে। কিন্তু এখানে তার নিজের বলতে কেউ নেই, অবশ্য কোলকাতা কেন দুনিয়াতেই বা তার নিজের বলতে কে’ই বা আছে? যাই হোক এক পথচারির দেখানো রাস্তায় আবার গাড়ি ছোটালো সে।

সংকলনের বাবা সুদেব রায় ছিলেন ডাক্তার। মালদা থেকে যখন সুদেব কোলকাতার মানিকতলা ই. এস. আই হাসপাতালে বদলি হল, তখন সংকলনের বয়স হবে ১০ বছর মতো। ওইটুকু বয়সে সে কোলকাতা মানেই জানত বড়ো বড়ো বাড়ি, সুন্দর রাস্তা, তাতে হু হু করে ছুটে চলা গাড়ি আর অনেক গুলো ব্রিজ।

কোনা হাইওয়ে দিয়ে সংকলনের গাড়ি ছুটে চলেছে অন্ধকার ভেদ করে। হাত ঘড়িতে সময় তখন রাত সারে নটা। যদিও ওর কোনো তাড়া নেই, নেই বাড়ি ফেরার বাধ্যবাধকতা। সংকলন কোলকাতায় এসেছে বউবাজারে তার বাবার তৈরী বাড়িটা বিক্রি করতে। বাবা-মা কেউ ই যখন নেই তখন আর মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? তেঘড়িয়াতে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট বুক করা আছে, ফাইনাল টাকা পয়সা মিটিয়ে ফ্ল্যাটের চাবি হাতে পেয়ে সে আবার দুবাই ফিরে যাবে। একা মানুষের জন্য এই ভালো। ভাবনার স্রোতে ভেসে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সংকলন, সামনে আসা ট্রাকটাকে পটু হাতে একটুর জন্য কাটিয়ে নিতে পেরেছে সে। মাত্র উনিশ বছর বয়স থেকে সে গাড়ি চালায়, মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে কলেজও যেত। পড়াশোনায় ভালো আর একমাত্র সন্তান হওয়ায় কোনো কিছুতে খুব একটা বাধা পেতে হয়নি সংকলনকে কখনো, শুধুমাত্র ওই…….. একটা দীর্ঘশ্বাস গাড়ির মধ্যেকার বাতাসটাকে ভারী করে তুলল।

সংকলনের গাড়ি ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে। কিছুদূর এগোনোর পর সংকলন দেখল কেউ হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বলছে। থামানোটা উচিৎ হবে কিনা ভাবতে ভাবতে তার সামনে এসে ব্রেক কষল সংকলন। একটি মেয়ে কাঁচ নামানোর ইশারা করছে। সংকলন কাঁচটা নামিয়ে বলল, “কোথায় যাবেন আপনি?” মেয়েটি বলল,” আগে দরজাটা খুলুন তো” সংকলন কি যেন ভেবে দরজাটা খুলতেই মেয়েটি ঝপ করে গাড়িতে উঠে বসে দরজাটা বন্ধ করে বলে, “চলুন এবার কোথায় যাবেন?” সংকলন অবাক হয়ে বলে,” আমি যেখানেই যাই না কেন, আপনি কোথায় যাবেন সেটা বলুন। “মেয়েটি হালকা হাসি ছড়িয়ে বলে, “আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব। আর যদি বলেন গাড়িতেই… তাতেও আমার…” চমকে ওঠে সংকলন। কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বলে ওঠে, “ এক মিনিট এক মিনিট, আপনি ঠিক কি মিন করতে চাইছেন বলুন তো?” এবার মেয়েটি একটু রেগে গিয়ে বলে, “আপনি কি বাচ্ছা নাকি যে আমার কথার মানে বুঝবেন না? নাই যদি শখ থাকে তো গাড়ি দাঁড় করালেন কেন?” সবটা এবার জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল সংকলনের। ।সে শান্ত হয়ে বলল,” দেখুন আপনি ভুল ভাবছেন। আমার মনে হয়েছিল আপনি হয়তো কোনো বিপদে পড়েছেন, তাই আমি… আচছা ঠিক আছে, আমারই ভুল, sorry। আমি সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে, আপনাকে যেখান থেকে গাড়িতে তুলেছিলাম, সেখানেই নামিয়ে দিচ্ছি। আর আপনার টাকাটাও…, না মানে কতো দেব?” মেয়েটি রেগে গিয়ে বলল,” কি বললেন আপনি টাকা দেবেন? কেন? দেখুন আমরা টাকার জন্য অনেক কিছু করতে বাধ্য হই ঠিকই, কিন্তু কারোর দয়া আমরা নিই না।“ সংকলন খুব ইতস্তত বোধ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ওকে কখনো পড়তে হয়নি। গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে একবার আড়চোখে দেখল মেয়েটিকে। আলো আঁধারিতে ভালো মতো দেখতে না পেলেও বেশ একটা আলগা চটক আছে। সংকলন একটু আমতা আমতা করে বলল,” না মানে ঠিক দয়া নয়, আসলে আপনাদের…” ঠিক কিভাবে কথাটা বলবে বুঝে উঠতে পারল না। “ শুনুন আপনাদের মতো বড়োলোকরা…” সামনে আসা ট্রাকের আলোয় সংকলনের মুখটা দেখে কথাটা আর শেষ করতে পারলনা মেয়েটি। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে বলল,” গাড়ি থামান আমি নামবো।“ সংকলন থতমত খেয়ে গেল। “ কেন কি হল? আমি নামিয়ে দেব তো, মানে আমি তো ফিরবই। মেয়েটি চিৎকার করে ওঠে, “গাড়িটা থামান বলছি, নয়তো আমি চলন্ত গাড়ি থেকেই….” বলে গাড়ির দরজার লক্ খোলার চেষ্টা করে মেয়েটি। সংকলন মেয়েটির হাতটা ধরে বলে,” আরে কি করছেন আপনি? পড়ে যেতে পারেন তো। “মেয়েটি আবার চেঁচিয়ে ওঠে, “এখুনি থামান, আমি নামবো“ সংকলন বোঝানোর সুরে বলে, “ দাঁড়ান থামাচ্ছি, কিন্তু কেন?” মেয়েটি কান্না ভেজা গলায় বলে,” শুভ প্লিজ” সশব্দে ব্রেক কষে থেমে গেল গাড়িটা। কয়েক মুহুর্তের জন্য সংকলনরে হৃদ্স্পন্দন থেমে গেল যেন। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইল মেয়েটি। আবার হাতটা চেপে ধরে সংকলন। “এক মিনিট, কি বললেন আপনি?” মেয়েটি বুজে আসা গলায় কোনো রকমে বলল, “ কিছু না, হাতটা ছাড়ুন প্লিজ।“ সংকলন হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে বলে, “ কে আপনি?” বলে গাড়ির আলো জ্বালাতে গেলে মেয়েটি বলে, “দয়া করে আলো জ্বালাবেন না।““ আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?” বলতে বলতে আলো টা জ্বেলে ফেলল সংকলন। মেয়েটি তখন দুহাতে মুখ ঢেকে নেয়। ভিতরে ভিতরে কেঁপে ওঠে সংকলন। কোনো রকমে বলে, “ঋতজা!” কেঁদে ওঠে মেয়েটি।

ইতিকথা

বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে জুলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের উজ্জ্বল ছাত্র তখন সংকলন রায়। ভালো ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি  সে ছিল কালচারাল সেক্রেটারি। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে প্রথম বর্ষের ছাত্রী ঋতজা পুরকাইতের আবৃত্তি শুনে মোহিত হয়ে গিয়েছিল সংকলন। তারপর এই দুটি মানুষের প্রেমের পথে যাত্রা শুরু করতে সময় লেগেছিল প্রায় ছয় মাস। তারপর বেশ সুখেই কাটছিল ওদের দিনগুলো। একটা দিন যেন ওদের দুজনের জীবন তছনছ করে দিল। সংকলন তখন কলেজ পাশ করে গেছে, ঋতজার দ্বিতীয় বর্ষ, একদিন সকালে সংকলনের বাড়ির ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। সংকলন ফোনটা ধরতে দুটো মাত্র কথা শুনে ওর যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। “মা আর নেই।“ ঋতজাকে এত ঠান্ডা গলায় কথা বলতে ও আগে কখনো শোনেনি। ছোটোবেলায় বাবাকে হারানোর পর ঋতজার মা ছাড়া আর কেউ নেই। “আসছি” বলে ফোনটা রেখে দিল সংকলন।

Own Drawing of সংকলন ও ঋতজা

রাত প্রায় ন’টা। বাড়ির ডোরবেলটা বাজিয়ে দমবন্ধ করা উত্তেজনায় মনের সব শক্তি সঞ্চয় করে টলমল পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সংকলন। সকাল ১০টায় আসছি বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে সে। ঢুকতেই তার মা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, কারন সংকলনের পাশে দাঁড়িয়ে ঋতজা। সংকলন কাঁপা কাঁপা গলায় অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলল,” ও আমার কলেজের বন্ধু। দুটো দিন যদি এখানে থাকে। আসলে ও খুব বিপদে পড়েই… না মানে তাই নিয়ে এলাম।“ সুদেব রায় বোঝানোর সুরে বলে,”এসব তুই কি বলছিস? সেটা কি করে হয়? চেনা নেই, জানা নেই, তাছাড়া…” সংকলন বাবার কথার মাঝেই বলে ওঠে,” ও ঋতজা, ঋতজা পুরকাইত। আমাদের কলেজে পড়ে, আমার বন্ধু। দমদম….” কথাটা শেষ করার আগেই সংকলনের মা বলেন,”ওকে টাকা দিয়ে দাও, যেখানে বাড়ি, সেখানে ফিরে যাবে।“ ঋতজা প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল,”sorry কাকিমা। আমি আসতে চাই নি, আমি চলে যাচ্ছি।“ সংকলন কাতর স্বরে বলল,”সেকি, না না। আসলে মা’রা তো কিছু জানে না,তাই… মা আমার কথাটা  একবার শোনো….” সংকলনের মা শান্ত গলায় বলল,”শুভ বন্ধু আর বান্ধবী মানে বিশেষ বান্ধবীর মধ্যে তফাৎ বুঝতে বাবা-মা এর চোখ ই যথেষ্ট।“ মাথা নীচু করে নিয়েছিল দুজনেই। সংকলন তাও বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,”আসলে আজ সকালে…” সংকলনের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,”বাবা-মা এর কথার অবাধ্য হওয়ার ছেলে তো তুমি না, সেটা কি সঙ্গদোষ নাকি?” আর কিছু বলতে পারল না সংকলন, শুধু দেখল ধীরে ধীরে ওর পাশ থেকে সরে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে ঋতজা।

 কথা ছিল, দেখা হবে

সেই দিনের সেই ঘটনার পর আজ দীর্ঘ ২০ বছর পর আবার সংকলন ও ঋতজা মুখোমুখি হোল। কিন্তু এভাবে? ঋতজার ক্ষনিকের আবেগ তখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কাঁধে হাত রেখেছে সংকলন। প্রথমবার সংকলনের দিকে সোজাসুজি তাকাল ঋতজা। ২০ বছর আগের সেই সদ্য যুবতী মেয়েটির চেহারার সাথে মিল থাকলেও অমিলও অনেক। সাজসজ্জাহীন সেই মুখে আজ চড়া মেকআপ। সংকলন নিজের মনের বোঝা হালকা করার জন্য বলতে শুরু করল,”সেই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে বাবা-মা আমায় ব্যাঙ্গালোর পাঠিয়ে দিয়েছিল এম. এস. সি পড়তে, অভিমানে বাড়ি আসিনি ২ বছর। বিশ্বাস করো মা যে এরকম ব্যবহার করতে পারে সেটা আমি একটুও আন্দাজ করতে পারিনি। তোমার বাড়িতে অনেক বার ফোন করেছি, কেউ ধরেনি, কলেজে খোঁজ নিয়ে জেনেছি তুমি আর কলেজ যাও না, জানিনা তুমি বিশ্বাস করবে কিনা, আমি তোমার অনেক খোঁজ করার চেষ্টা করেছি। শেষ বারো বছর ধরে আমি দুবাইতে আছি চাকরি সূত্রে, বাবা-মা আর নেই গো। তারাও কোনোদিন আর শান্তি পায়নি, মানে আমি দিইনি বা বলা ভালো দিতে পারিনি।“ ঋতজা একটু কাষ্ঠল হাসি হেসে বলল,”এতো বছর পর এসব আমায় বলে কি লাভ?” সংকলন দুহাতে ওর মুখটা ধরে বলে,”তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলবো? কে’ই বা আছে আমার আর? তাছাড়া তোমার ও তো জানা দরকার….” ঋতজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”কি হবে এসব জেনে? শুভ খোঁজার মতো করে কাউকে খুঁজলে ঠিকই পাওয়া যায়। অবশ্য না খোঁজ পেয়ে একপক্ষে ভালোই হয়েছে। আশা করো না তোমার মতো আমিও আমার অতীত ইতিহাসের বই খুলে বসবো। “সংকলনের চোখে জল এসে গেল। বলল,”অভিমান তো? হওয়াটা’ই স্বাভাবিক।“ ঋতজা সশব্দে হেসে বলল,”অভিমান? কার ওপর? তোমার ওপর? কেন? তুমি ওই বয়সে যেটা করেছিলে সেটা ও অনেকে করতে পারতো না। আমার কারোর ওপর কোনো অভিমান ই নেই, তবে তুমি যে ঋতজা বলে কাউকে চিনতে সেটা ভুলে যাও, এখন যাকে তুমি দেখছো সে শুভা, শুধু শুভা। পথে চিনে লোকে তাকে পথেই ভুলে যায়।“ নামার উপক্রম করে ঋতজা। সংকলন দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঋতজাকে। কাতর স্বরে বলে,”প্লিজ এরকম করে বোলো না। আমি খুব একা, বিয়ে তো দূর, তুমি ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতেও পারিনি। আমার সাথে দুবাই…” সংকলনকে সরিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল ঋতজা। বলল,” তোমার আর আমার রাস্তা এখন আলাদা। তোমার রাস্তায় আমি আর হাঁটতে পারবো না, আর আমি চাই না তুমি আমার রাস্তায় আর কোনোদিন আসো, প্রার্থনা করি আমাদের যেন আর কখনো দেখা না হয়। মনে আছে কলেজে পড়তে তুমি আমায় লং ড্রাইভে নিয়ে যাবে বলেছিলে,দূরে না হোক গাড়িতে তো চাপা হলো,এই অনেক। আমাকে না ভুলতে পারলেও এই কয়েক মুহুর্তের সাক্ষাত টা ভুলে যেও। অন্তত স্মৃতিটা মধুর থাকবে।“ চলে যেতে গিয়েও থমকে গিয়ে বলল,”ভালো থেকো। এই পথে কোনোদিন ও আর এভাবে গাড়ি থামিও না।“ “কিন্তু শোনো ঋতজা….” না ওর পিছুডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি ঋতজা। চোখের জলটা মুছে মনে মনে ভাবল আজ ও তোমার চলে যাওয়া আটকাতে পারলাম না।

সংকলন ও ঋতজা চরিত্র কোন ব্যক্তিগত চরিত্র থেকে অনুপ্রানিত নয়। এটি সম্পূর্ন আমার মনের কল্পনা।

লং ড্রাইভের মতো আরো কিছু নতুন গল্প পড়তে ক্লিক করতে ভুলবেন না ধারাবাহিক

 

One Reply to “লং ড্রাইভ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *