শ্রীরামপুর – এই শহরেই জন্ম আমার। আমার শহর বিশেষ বড় নয়, কিন্তু তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি। এই শহর হয়তো একটু জনবহুল, সবুজের ঘনঘটাও কম, কোথাও কোথাও চোখে পড়ে পথঘাটের বেহাল দশা, বেশ কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ভরসা করতে হয় কোলকাতার মতো বড় কোনো শহরের ওপর, তবু এই শহরে প্রাণ আছে, আন্তরিকতা আছে। ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে রাখার ক্ষমতা রাখে আমার শহর শ্রীরামপুর।

Famous Rathayatra of Mahesh in শ্রীরামপুরএই শহরের নামকরনের ইতিহাস নিয়ে মতবিরোধ আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত মত হল, এখানে অবস্থিত প্রাচীন শ্রীরাম- সীতার মন্দিরে কারনে এই শহরের নাম হয় শ্রীরামপুর। পরাধীন ভারতে এই শহর ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০ বছর ধরে ছিল ডেনমার্ক-এর অধীনে। তখন যদিও শহরটা পরিচিত ছিল ফ্রেডরিকনগর নামে। এই শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের নানান রসদ। বর্তমানে শিল্পশহর হিসাবে পরিচিত এই শ্রীরামপুর ইতিহাসের এক পরিচিত নাম।

যখন স্কুলজীবনে ইতিহাসের পাতা উল্টে পড়তাম, ভারতের প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয় শ্রীরামপুরে অথবা প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ও গড়ে উঠেছিল এই শহরেই, যখন ভূগোলের শিক্ষিকা পড়াতেন ভারতের প্রথম চটকল স্থাপিত হয়েছিল এই শ্রীরামপুর শহরে , আবার কখনো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’ পড়তে বসে যখন রাধারানীর মাহেশের রথের মেলায় বনফুলের মালা বিক্রি করতে আসার কাহিনী পড়তাম, সেই রথযাত্রা যা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীন রথযাত্রা- এইসব কিছু পড়তে পড়তে যে বুকটা গর্বে ভরে উঠত না তা নয়। মনে হতো আমি এমন এক শহরে জন্মগ্রহন করেছি যার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। শুধু এখানেই শেষ নয়, ভারতের মধ্যে প্রথম কাগজের কল, দ্বিতীয় মহাবিদ্যালয় ও গড়ে ওঠে এই শহরেই। এই শহরেই জন্মগহণ করেছিলেন স্বদেশি যুগের অন্যতম শহিদ গোপিনাথ সাহা। শুধু ইতিহাস নয় ভাষাসাহিত্যেও শ্রীরামপুর – এর পরিচিতি বহু প্রাচীনকাল থেকে। এখানকার আকনা ও মাহেশ নামক জায়গা দুটির উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে। চৈতন্যদেবের সময়কালের এক লেখা থেকে পাওয়া যায় এই শহরের চাতরা নামক অপর এক স্থানের উল্লেখ।

                                          Photo of Historical শ্রীরামপুর College এখনো মনে পড়ে সেই দিনটার কথা, ২০০৬ সালের অগাস্ট মাসের কোনো এক সকালে, যখন প্রথমবার ছাত্রী হিসাবে পা রাখলাম শ্রীরামপুর কলেজে, মনে পড়ে গেল ছোটবেলার স্মৃতি। শৈশবে নিজের বাড়ির পর যদি কোনো জায়গা সবচেয়ে ভালো লেগে থাকে, তাহলে তা হল এই কলেজ। মা’এর হাত ধরে এসে দাঁড়াতাম গঙ্গার ধারে। সেখান থেকে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় রাঙা কলেজটা দেখতে খুব ভালো লাগত। যদিও এর ঐতিহাসিক মূল্য বোঝার মতো বোধ তখনও আমার হয়নি, তবু এখানের সুবিশাল মাঠ, সুউচ্চ থাম, বড় বড় জানালা, সবুজের সমারহ আমাকে আর্কষণ করতো। আর শরতে এক রাস কাশফুল, শীতের ঝরাপাতার রাশি, বসন্তে ঝরে পড়া রাধাচূড়া ফুলে হলুদ হয়ে যাওয়া রাস্তা- এগুলো ছিল উপরি পাওনা। পরে এই ইতিহাস খ্যাত কলেজের অংশ হতে পেরে গর্ব অনুভব করেছি। ২০০৭ সালে যখন দাদার সাথে গিয়েছিলাম কোলকাতা বইমেলায়, তখন শ্রীরমপুর কলেজের আদলে তৈরি প্যাভেলিয়ন দেখে এবং সেখানে উপস্থিত মানুষদের মুখে আমাদের কলেজের সৌন্দর্যের কথা শুনে সত্যি বলতে একটু অহংকার তো হয়েছিল।

                                                           শুধু ঐতিহাসিক, ভৌগলিক বা সাহিত্যিক দিক নয়, এই শহর পূজার্চনার দিক থেকেও বেশ প্রসিদ্ধ। ৪১৫ বছর আগে এখানকার গোঁসাই বাড়িতে শুরু হয় মা দূর্গার পূজা, দে বাড়ির দূর্গাপূজার বয়স’ও প্রায় ২১৫ বছর। পূজাগুলি আজও স্বমহিমায় পালন হয়ে চলেছে। এছাড়া এখানে অবস্থিত বিখ্যাত জগন্নাথ দেবের মন্দির, শ্রী শ্রী রাধাবল্লভ জিউ মন্দির ইত্যাদি। রাসপূর্নিমা উপলক্ষে এই শহরে অনুষ্ঠিত হয় শ্রীকৃষ্ণের নগর পরিক্রমন।

ভালোলাগা ও ভালোবাসার এমন নানান রসদ ছড়িয়ে আছে আমার এই শহর শ্রীরামপুরে। তাই শহরের টানে বারবার ফিরে আসি।

এমনই আরো কিছু অনুচ্ছেদ পড়তে চাইলে অবশ্যই ক্লিক করুন প্রথম পাতা

শ্রীরামপুর শহর সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন উইকিপিডিয়া

One Reply to “আমার শহর শ্রীরামপুর”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *