১৫ দিন পর

ঋতম অফিসে কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে কাজে ডুবে আছে। পাশ থেকে সহকর্মি অজিতেষদা ডাকল, “ ভাই ঋতম ফোনটা আর কতক্ষন বাজবে, এবার তো ধরো।“ “ ওহ! সরি সরি, খেয়াল করিনি” বলে পকেটে হাত দিতেই সুরেলা রিংটোন থেমে গেল। ঋতম ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল মিসড্ কলের লিস্টে লাল রঙে লেখা বাবা। বাবা ফোন করেছিল? একবার হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে একটু অবাক হল। দেরি না করে কল চিহ্নে আঙুলটা ছোঁয়ালো ঋতম। ফোনটা ধরেই প্রিয়ব্রত বললেন, “তুই কি ব্যস্ত বাবান?” ঋতম বলল, “না না তেমন কিছু না, আসলে ফোনটা বাজছিল খেয়াল করিনি। বলো কিছু দরকার আছে?” প্রিয়ব্রত একটু ইতস্তত করে বললেন, “ আমি এখন তোর অফিসের সামনেই আছি, তোর তো ছুটির সময় হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম তোকে একবার ফোন করে দেখি।“ ঋতমের কপালে চিন্তার ভাঁজ, বাবা অফিসের সামনে? কই আগে তো কখনো আসে নি? ঋতম বলল, “বাবা কিছু হয়েছে?” ছেলের গলার উদ্বেগ ধরতে পেরে প্রিয়ব্রত বললেন, “আরে তুই এত ভাবছিস কেন? এদিকে একটু কাজে এসেছিলাম, কাজ মিটিয়ে দেখলাম তোর’ও ফেরার সময় হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম ফোন করে দেখি। তোর কাজ থাকলে ছাড়, আমি বাড়ি যাচ্ছি।“ কাজ সত্যি’ই ছিল ঋতমের। ভেবেছিল আজ একটু বেশিক্ষন থেকে সেরে নেবে, কিন্তু বাবা তো আর রোজ আসে না। “বাবান?” প্রিয়ব্রতর ডাকে সম্বিত ফিরল ঋতমের। বলল, “হ্যাঁ?” প্রিয়ব্রত বললেন, “আমি কি তাহলে এগোবো?” ঋতম বলল, “আরে না, তবে একটু যে দাঁড়াতে হবে।“ চিন্তিত কন্ঠে প্রিয়ব্রত বললেন, “অনেকক্ষন?” ঋতম হেসে বলল, “না না একটুক্ষানি। “

অফিসের বাইরে বেড়োতে বেড়োতে একবার হাতঘড়ির দিকে তাকালো ঋতম, মিনিট দশেকের বেশি অপেক্ষা করতে হলো বাবাকে। এমনিতে কাউকে অপেক্ষা করানো বা নিজে অপেক্ষা করাদুটোই বিশেষ পছন্দের নয় ঋতমের, কিন্তু হঠাৎ এলে তো আর কিছু করার থাকে না। রাস্তায় পা রেখে দেখল, বাবা দাঁড়িয়ে আছে পাশের বাসস্ট্যান্ডে। ঋতম পাশে এসে বলল, “sorry, একটু অপেক্ষা করতে হলো।“ কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তার ছাপ লক্ষ্য করল ছেলে। পাত্তা না দিয়ে বলল, “চলো আগে কিছু খাই, তারপর বাড়ি ফিরব। মা’য়ের জন্যও কিছু নিয়ে নেবো। প্রিয়ব্রত একটু আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ মানে…” ঋতম বলল, “কি হলো কিছু বলবে?” প্রিয়ব্রত বলল, “আসলে আমার সাথে একজন…” ঋতম অবাক হলো। বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল, “আর একজন? কে?” ঋতমের কথার মাঝেই ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে। প্রিয়ব্রত বললেন, “এবার চল।“ ঋতম এবার মাথা ঠান্ডা রাখতে পারল না। নিজের অজান্তেই গলার স্বর চড়ে গেল, “মানেটা কি? তুমি কি শুরু করেছো বলোতো? কে উনি? আমি তো চিনি না।“ ঋতম দেখল মেয়েটি মাথা নীচু করে নিল, বোধহয় অপমানিত হয়েছে, তাতে ওর কিছু করার নেই। প্রিয়ব্রত নীচু স্বরে বলল, “বাবান প্লিজ, আগে চল, সব বলবো তোকে।“ বাবার সাথে তর্ক করার স্বভাব ঋতমের নেই, অচেনা কারোর সামনে তো কথাই নেই।প্রিয়ব্রত - Photo of a Food Cafe

রেস্টুরেন্টে প্রিয়ব্রত পাশে বসেও মেয়েটি একইরকম ভাবে মাথা নীচু করে রইল।  ঋতম মেয়েটির বিপরীতের চেয়ারে বসল বিরক্তি সহকারে। মনে মনে ভাবল, বাবা কি করতে চাইছে? কিছুদিন আগে একটা মেয়ের ফটো নিয়ে হাজির হলো, আজ জলজ্যান্ত আর একজন মেয়েকে নিয়ে চলে এলো, বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকে তো নাকি? কার পক্ষে মাথা ঠান্ডা রাখা সম্ভব? মেয়েটি’ই বা কি ভাবছে। একবার মেয়েটির দিকে তাকালো ঋতম। বেশ কিছুক্ষন সময় কেটে গেল নীরবতায়। প্রিয়ব্রতর মনে দ্বিধাবোধ, কাজটা কি ঠিক হলো? পরিবেশ হালকা করতে তিনি বললেন, “বাবান, ও মেঘাশ্রী, সেদিন তোকে ওর কথা বললাম যে, ফটো’ও দিয়েছিলাম। ঋতম একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো মেয়েটির দিকে, মেয়েটি তখনো মাথা নীচু করে আছে। কিন্তু মনে হলো মেয়েটির চোখে জল, আর সেটাই স্বাভাবিক। আসলে ছবিটা ঋতম এতই কম সময়ে দেখেছে, যে তাতে চেহারা মনে রাখা সম্ভব না। প্রিয়ব্রত মেঘাশ্রীর উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা কথা বলো, আমি একটু আসছি। প্রথমবার মুখ তুলল মেঘাশ্রী। করুন চাহনিতে না যাওয়ার অনুরোধ জানাল প্রিয়ব্রতকে। সেই চাহনি উপেক্ষা করে একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে রেস্টরেন্টের দরজার দিকে পা বাড়ালেন প্রিয়ব্রত। নীরবতার সাগরে ঝিনুক খোঁজার মতো কথা খুঁজতে থাকে ঋতম। কিভাবে শুরু করবে? একটা স্যরি তো বলা উচিত। নিস্তব্ধতা ভেঙে ঋতম বলল, “স্যরি, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি। আসলে সেদিন ছবিটা….” প্রথমবার মেঘাশ্রী সরাসরি তাকালো ঋতমের দিকে। চোখের কোণটা তখনও ভেজা। ওর চাহনি ঋতমকে আর কথাটা শেষ করতে দিল না। মেঘাশ্রী বলল, “দুঃখিত তো আমি, আপনি কেন স্যরি বলছেন? আপনার বাবার কথায় রাজি হয়ে আমার এভাবে আজ আসাটা উচিৎ হয়নি, কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনি যে কিছুই জানতেন না এটা আমার জানা ছিল না, তাহলে আমি আসতাম না। তবে এটা ঠিক যে আমিও আসতে চেয়েছিলাম। প্রথমত, আপনাকে আমার কয়েকটা কথা সরাসরি বলা প্রয়োজন বলে মনে হয়। আর দ্বিতীয়ত, উনি অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ, আমার….” ঋতম বলে উঠল, “বাবার মতো তাই তো? আসলে আমার বাবাও মাঝে মাঝে…” মেঘাশ্রী বলল, দেখুন বাবার মতো কিনা জানি না, আমি তো আমার বাবাকে কোনোদিন দেখিনি।“ মাথাটা আবার নামিয়ে নিল মেঘাশ্রী। ঋতম নীচু স্বরে বলল, “স্যরি আমি ভুলে গেছিলাম আপনার বাবা-মা নেই।“ মেঘাশ্রী বলল, “আমার মনে হয়, আমার যা বলার আছে সেটা আপনাকে তাড়াতাড়ি বলে চলে যাওয়া উচিৎ।“ ঋতম পরিবেশটা হালকা করতে মেনুকার্ডটা এগিয়ে বলল, “সেসব কথা হবে, আগে কিছু যদি….” মেঘাশ্রী মেনুকার্ডটা ঋতমের দিকে সরিয়ে একটু রাগত স্বরে বলল, আপনার কি মনে হয় ঋতম বাবু আমি এখানে খেতে এসেছি? একদিনের মতো অনেক অপমান তো হলো।“ চোখ নামিয়ে নিল ঋতম। মেঘাশ্রী বলল, “দেখুন আপনার -আমার  দুজনের’ই সময়ের দাম আছে। তাই অকারন তা নষ্ট না করে আমার যা বলার সেগুলো বলে ফেলি, ঋতম বাবু আপনি অর্ধসত্য জানেন। বাবা-মা না থাকা একরকম, কিন্তু আমি জানি না আমার বাবা কে, মা’কে জন্মের পর’ই হারাই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আপনাদের মতো সহজ সরল জীবন আমার নয়। এর থেকে বেশি কিছু  আমি একজন সদ্য পরিচিতকে বলতে পারবনা। আমি জানিনা আপনার বাবার আমায় কেন এতো পছন্দ হয়েছে, কিন্তু আমি সত্যি চাইনা বিয়ে নিয়ে  কিছু ভাবতে। আপনি বিচক্ষন, আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমার কথা আর আপনার বাবাকেও বুঝিয়ে বলতে পারবেন। আমি এবার আসি, আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।“ কথাগুলো বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেঘাশ্রী। ঋতম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু বাবা ফিরুক অন্তত।“ মেঘাশ্রী বলল, “আপনি নাহয় ওনাকে বলে দেবেন।“ একপলক ঋতমের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দরজার দিকে পা বাড়ালো। ঋতমের কেন জানে না ইচ্ছা হলো হাতটা ধরে থামাতে কিন্তু পারল না। শুধু কাঁচের দরজা ঠেলে তার চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

ঋতমের জীবনে কীভাবে এল মেঘাশ্রী ? যদি না জেনে থাকেন অবশ্যই পড়ুন শেষ বলে কিছু নেই –  পর্ব এক

শুধু ওয়েবসাইট নয়, আপনারা আরো অতিরিক্ত কিছু লেখা পেতে ও অনুলিপির আপডেট পেতে ফলো করুন ইন্সটাগ্রামে

One Reply to “শেষ বলে কিছু নেই – পর্ব দুই”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *