দিনটা ছিল শুক্রবার। ঘড়িতে সকাল সাড়ে ন’টা মতো বাজে। বাজার সেরে একটু আয়েশ করে খবরের কাগজ আর চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম। আজকাল বাজার যেতে আর তেমন ভালো লাগে না, বিশেষ করে মাছের বাজারে। এতো জলকাদায় ঘেন্না করে। অথচ এই আমি আগে মাছের বাজারে চারবার চক্কর না কেটে মাছ কিনতাম না। বয়সের সাথে সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়। ওই আবাসনের গেটের কাছে যা বসে তাই কিনি। কিন্তু মাছওয়ালার মা মারা গেছে বলে আসছে না, আর মৎসপ্রেমী বাঙালি জাতির প্রতিনিধি হয়ে কদিন’ই বা মাছ ছাড়া চলে। যাক বাজার পর্ব থাক, যে খবরে চোখ আটকে গেল। “মায়ের স্বীকারোক্তি”। খবরের কাগজটা আর একটু চোখের কাছে তুললাম, স্বামীকে হত্যা করার পর পুলিশের কাছে এক মায়ের স্বীকারোক্তি। হঠাৎ বেল বেজে উঠল, এখন আবার কে এলো? দরজা খুলে দেখি একটি মেয়ে, মুখটা চেনা, আবাসনে দেখেছি, কিন্তু আমার বাড়িতে কেন? মেয়েটি বলল, “আপনি অর্ধেন্দু শঙ্কর পাল তো?” আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, “শঙ্কর না শেখর।“ মেয়েটি বলল, “সে যাই হোক, আপনি কি জানেন, কাকাবাবু কি কোথাও গেছেন?” আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, “কোন কাকাবাবু?” মেয়েটি বামপাশে হাত দেখিয়ে বলল, “আরে আপনার পাশের ফ্ল্যাটের চতুর্বেদী কাকা। আমি ওনার বাড়িতে কাজ করি। কাল কাজ করে ফেরার সময় কাকাবাবু বলেছিলেন, ওনাকে যদি বাড়িতে না পাই, তো আমি যেন আপনার কাছে খোঁজ নি। আপনি কি কিছু জানেন?” আমি অবাক হলাম। বললাম, “আমি তো জানিনা। তুমি কি অনেকবার বেল বাজিয়েছিলে? ফোন করেছিলে?” মেয়েটি বলল, “বেল তো অনেকবার বাজালাম, খুলল না। তবে ফোন করার কথা মাথায় আসে নি।“ আমি বললাম, “আমি দেখছি কল করে, তুমি দাঁড়াও আমি মোবাইলটা আনি।“ মেয়েটি বলল, “একটু জলদি করুন, আমায় আরো বাড়ি যেতে হবে তো।“ আমি ঘুরে ধমকের সুরে বললাম, “কাজ দেখাচ্ছ, একজন মানুষের খোঁজ পাচ্ছনা, তার কোনো চিন্তা নেই। মানুষটা তো অসুস্থ ও হতে পারে। একা থাকে।“ বকা খেয়ে মেয়েটি মাথা নামিয়ে নিল। আর বকুনির শব্দে আমার স্ত্রী প্রমিতা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে? “আমি বললাম দাঁড়াও আগে মোবাইলটা আনি।“
প্রায় আধঘন্টা পেড়িয়ে গেছে, চতুর্বেদি না ফোন তুলছে, না দরজা খুলছে। কি হল মানুষটার? আমার আর প্রমিতার সাথে সাথে আশেপাশের আরো বেশ কিছু ফ্ল্যাটের আবাসিকরাও এসেছে। কাজের মেয়েটি কিছুক্ষন থেকে চলে গেল। মানুষটা যদি বাইরে কোথাও থাকে তো ফোন কেন ধরবে না। কপালের ভাঁজ ক্রমশ গভীর হতে লাগল। গতকাল অন্যদিনের মতো নীচের লনে পায়চারি করতে নেমে ফোন করেছিলাম চতুর্বেদিকে। জিজ্ঞাসা করলাম “কি ভাই নামবে না?” বলেছিল অবশ্য শরীরটা ভালো নেই, আজ আর ইচ্ছা করছে না। জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, “কি হয়েছে? তেমন হলে আমাদের ব্লকের ডাক্তার তরফদারকে একবার বলি এসে দেখে যাবে।“ বলল, “তেমন কিছু না, একটু শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে, মনটা বিশেষ ভালো নেই।“আমি বিশেষ আর কথা বাড়াইনি, শুধু বলেছিলাম, “দরকার হলে ফোন করতে বা ডাকতে দ্বিধাবোধ করো না।“ আমি বুঝি একাকিত্বের বোঝা বড়ই কঠিন। কিন্তু এখন কি করবে? বেশি রকম কিছু হলো নাকি? অজ্ঞান হয়ে গেছে হয়তো, নাকি….. এমা ছিঃ এসব কি ভাবছি। নিজের ওপর নিজের রাগ হলো। কাল একবার যদি রাতে যেতাম ফ্ল্যাটে। হয়তো আমাদের বিরক্ত করতে চায়নি বলে জানাননি কিছু। এরই মাঝে একজন বললেন, “আমার মনে হয়, আর দেরী না করে, সিকিউরিটি কে ডাকা উচিৎ।“
বেলা তখন সাড়ে এগারোটা, চতুর্বেদির ফ্ল্যাটে তখন অনেক উৎসুক লোকের ভিড়। আমার তো বিশ্বাস’ই হচ্ছে না যে মানুষটা আর নেই। সিকিউরিটি অফিস থেকে পুলিশে খবর দিয়েছে, কারন মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক নয়, ইচ্ছামৃত্যু তা বুঝতে কারোর বাকি নেই। এক আবাসিক ডাক্তার দেখে জানান মারা গেছেন কম করে ছয় থেকে সাত ঘন্টা আগে, তবে সঠিক সময় বলা এখন সম্ভব নয়। আমার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মিসেস রায় এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ কি হলো বলুন তো অর্ধেন্দু দা? আপনি কি কিছু জানতেন? আমার হাজবেন্ড’ও তো ইন্দোর গেছে, আর তো কারোর সাথে উনি তেমন মিশতেন না।“ আমি তখনও সামলে উঠতে পারিনি, ঘোর কাটেনি, কি বলবো বুঝতে পারছি না। মুখে যেন কথা সরছে না। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন তিন জন পুলিশ। ঘরটা ফাঁকা করতে বললেন। বেড়িয়ে যেতেই যাচ্ছিলাম, প্রশ্ন ভেসে এলো, ওনার পরিবারের কে আছেন? একজন সিকিউরিটি বলল, “উনি তো একাই থাকতেন, তবে এই পালবাবুর সাথে ভালো বন্ধুত্ব ছিল।“ পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “পালবাবু কে?” আমি কিছু বলার আগেই প্রমিতা বলে উঠল, “না অফিসার ঠিক বন্ধুত্ব না, ওই পাশেই থাকি তাই…” আমি প্রমিতাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললাম, অফিসার আমি অর্ধেন্দু শেখর পাল। চতু্র্বেদির প্রানহীন দেহের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, বিনিত চতুর্বেদি আমার প্রতিবেশী, ঠিক বন্ধুত্ব না হলেও সখ্যতা ছিল। উনি আমার থেকে বছর ছয়েকের ছোট, বিপত্নিক, এক মেয়ে আছে শুনেছি টোকিও তে, কিন্তু দেখিনি, পরিচয়ও নেই। আসলে চতুর্বেদি এই আবাসনে আছেন ২০১৯ থেকে। কখনো কাউকে আসতে দেখিনি ওনার বাড়ি। পরিবার নিয়ে খুব একটা কিছু বলতেন না। আসলে মানুষটা একটু অন্তর্মুখী। ওই আমার আর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের রথীন রায় এর সাথেই তবু যেটুকু যা মিশতেন। রথীন এখন ইন্দোরে আছে, ওর ভাই এর কাছে।“ একটানা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন ওনার মেয়েকে খবর দেওয়া হয়েছে কিনা। আমি বললাম, “না। মেয়ের কোন নম্বর জানা নেই, আর ঘটনার আকস্মিকতায় মাথায় ও আসেনি। হয়তো চতুর্বেদীর মোবাইলে পাওয়া যাবে নম্বর।“ মোবাইল লক থাকায় তা পুলিশের জিম্মায় গেল। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলেন আমি কিছু জানি কিনা, কেন এমন সিদ্ধান্ত? আমি বললাম, “দেখুন সেটা ঠিক জানিনা। গতকাল রাতে ওই ৮টা নাগাদ ফোনে একবার কথা হয়েছিল, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নীচের লনে আসবে কিনা, বলেছিল, ওর মনটা তেমন ভালো নেই, তবে কারন কিছু বলে নি।
দুপুর প্রায় তিনটে বাজে। কোনো রকমে একটু কিছু খেয়ে মোবাইলটা হাতে নিলাম। জামাইকে সকালের মধ্যে একটা ডকুমেন্ট মেল করার ছিল, এইসব কিছুর ঝামেলায় মাথা থেকে একদম বেড়িয়ে গেছিল। মাথার’ই বা আর দোষ কি, যা হয়ে গেল আজ। এখনো ভাবতে পারছি না, যে মানুষটার সাথে গতকাল রাতে কথা হল, তার নিথর দেহ আজ লাশকাটা ঘরে বন্দি। কি এমন হলো যে এমন একটা মারাত্বক সিদ্ধান্ত নিতে হলো? চতুর্বেদি প্রায় ৬ বছর ধরে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে, তাহলে কাল রাতে কি হলো? কে জানে পুলিশ ওর মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারল কিনা। হঠাৎ মনে পড়ল, ডকুমেন্টের কথা। আগে পাঠাই, নয়তো আবার ভুলে যাব। কাজটা সেরে হোয়াট্সঅ্যাপে অন হয়ে দেখি বেশ কিছু না পড়া ম্যাসেজ। শেষ থেকে পড়া শুরু করবো ভেবে চোখ আটকে গেল। চতুর্বেদির ম্যাসেজ! চটপট সময়টা দেখলাম, রাত দুটো। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে পড়া শুরু করলাম।
আমি জানি পালবাবু আপনি এখন ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু আমার ও আর উপায় নেই। এবার বোধহয় সময় হয়ে গেছে। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর যার জন্য এতোদিন বেঁচে ছিলাম, দুদিন আগে সেই আমাকে অস্বীকার করল। আর থেকে কি করি বলুন? স্বীকারোক্তি যখন করছি’ই তাহলে আপনাকে অর্ধসত্য বলা ঠিক না। আপনি জানেন হয়তো আমার এক মেয়ে। আসলে উনি আমাদের নিজের সন্তান নয়। আমার স্ত্রী কোনোদিন মা হতে পারবে না, এটা জেনেই আমরা বিয়ে করি। আসলে বড় ভালোবেসে ফেলেছিলাম যে। মেহুল আমার বোনের মেয়ে। বিয়ের আগের আমার বোন আর ভগ্নিপতির সন্তান। সম্মান রক্ষার জন্য ওর জন্মের তিন দিন পর থেকেই আমরা ওকে মানুষ করি। একসময় ভুলে যাই ও আমাদের নিজের সন্তান নয়। আর আমার স্ত্রী তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। একটা সম্পূর্ন সুখী পরিবার হয়ে গেল আমাদের। মেহুল কোনদিন জানত না ওর কোনো পিসি আছে। কিন্তু এতদিনের লোকানো সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। যে মেয়ে মা অন্ত প্রাণ ছিল সেই মেয়ে গত পরশু আমায় ফোন করে স্বর্গীয় মায়ের নামে অনেক খারাপ কথা বলে। আমরা নাকি অন্যায় করেছি, নিজেরা সন্তান সুখ পাবো বলে জোর করে ওর আসল মায়ের থেকে দূরে রেখেছিলাম। পালবাবু পরশু যে টোকিও তে দাঁড়িয়ে ও এত অভিযোগ করছিল, সেখানে গবেষনা করতে পাঠাতে আমার স্ত্রী তার বেশিরভাগ গয়না বিক্রি করে দিয়েছিল। মেহুলের যখন ১২ বছর বয়স তখন আমার ৫ মাসের জন্য চাকরি ছিল না, জানি না কোথা থেকে প্রতি রবিবার টাকা দিত মেয়ের জন্য মাংস আনতে, কারন ও রবিবার মাংস ছাড়া ভাত খেতে চায়না। এতকিছুর পর ও আমরা নাকি স্বার্থপর পালবাবু। আমাদের নাকি উচিৎ ছিল জন্মের পর’ই ওকে মেরে ফেলা। পেটে না ধরলে নাকি কোনদিন’ই সঠিক অর্থে মা হওয়া যায় না। মেহুলের সেদিনের ফোনে আমার পায়ের তলার জমি আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা দুটোই চলে গেছে। কিন্তু আত্মহনন মহাপাপ। আর আমি জ্ঞানত আর কোনো পাপ করিনি। শুনেছি পাপ স্বীকার করলে নাকি পাপের বোঝা কিছুটা কমে। তাই আপনার কাছে এই স্বীকারোক্তি। পারলে ক্ষমা করবেন।
আমি তড়িঘড়ি ফোন করলাম পুলিশ স্টেশনে। “ আমি অর্ধেন্দু শেখর পাল বলছি শান্তির নীর আবাসন থেকে। আপনারা কি বিনিত চতুর্বেদির মেয়েকে ফোন করেছিলেন?” বিপরীত দিকের প্রতিউত্তর শুনে বললাম, “না তো। দয়া করে করবেন না। আমি আসছি থানায়, এসে কারনটা বলছি। রাখছি ,ধন্যবাদ।”
আরো একটি ছোটগল্প পড়তে চাইলে ক্লিক করুন লং ড্রাইভ।
Onoboddo
Thank you