হালকা সুরে ম্যাসেজ টোন টা বেজে উঠল। ঘুম জড়ানো আধবোজা চোখে বাঁ হাতে মোবাইলটা খুঁজছে, নাগালের মধ্যে পেয়ে আনলক করে দেখে রাত ১১ টা ৪০ বাজে। একটু যেন অবাক হলো,”পিউ ম্যাসেজ করেছে এত রাতে?” তাড়াতাড়ি পড়ে ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল,”বাবার শরীরটা খারাপ করছে, হালকা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ইনহেলার’টাও শেষ। কি করি বলো তো?” মাথাটা ব্যাথা করছিল বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল, ম্যাসেজটা পড়ে ব্যাথাটা আরো বেড়ে গেল। কিছু না ভেবেই লিখল,”আসছি।“ চটপট জিন্স আর কুর্তিটা গলিয়ে নিল, শালটা কি নেবে? নিয়ে নেওয়াই ভালো। নভেম্বর মাস প্রায় বিদায় এর পথে। যদিও আজকাল তেমন ঠান্ডা পড়ে না কোলকাতায়, তবে রাত হয়ে গেছে। একবার পার্সটা খুলে দেখে নিল, ডেবিট কার্ড দুটো আছে তো? বলা যায় না কখন কি পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ড্রয়ার খুলে দ্রুত হাতে গাড়ির চাবিটা নিয়ে ফ্ল্যাট লক করে লিফ্টের দিকে প্রায় দৌড়াল সে।

রাতের প্রায় নিস্তব্ধতার মাঝে গাড়ি ছুটে চলল বিডন স্ট্রিট এর দিকে। চাপা টেনশানে যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে দক্ষ হাতে গাড়ি ছোটাচ্ছে সোলাঙ্কি দত্ত সরকার। সারা জীবন দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়েই রয়ে গেল, নিজের ওষুধ গুলো আছে না শেষ হয়ে গেছে সেটুকু ও খেয়াল রাখতে পারে না। আসলে কোনোদিন তো কোনো দিকে নজর দিতে হয়নি। বাবা-মা এর একমাত্র সন্তান সোলাঙ্কির বেড়ে ওঠা কানপুরে। বরাবর’ই স্বাধীনচেতা প্রকৃতির মেয়ে সে। নার্সারি থেকে বি.সি.এ অব্দি সবটাই তার কানপুরে, তারপর বাবার চাকরি শেষে শিকড়ের টানে ফিরে আসা কোলকাতাতে। ফিরে এসে এম.সি.এ করে সবে একটা বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি শুরু করেছিল, এমন সময় পিসেমশাই মারফত আসে বিয়ের সম্বন্ধ। বর্তমানে ফিরে আসে সোলাঙ্কি। দূর থেকে সিগনালের হলুদ আলোটাকে লাল হয়ে যেতে দেখল সে। তার মানে ক্ষনিকের বিরতি। আবার স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যায় সে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটা… দুপুরে এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। জুলাই মাসের কোনো এক রবিবার ছিল। দুপুর থাকতে থাকতেই বাবা-মা ওদের দু’কামরার ফ্ল্যাটটা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পাঁচটা নাগাদ তাদের আসার কথা। পাঁচটা পনেরো নাগাদ ডোরবেল বাজতে বাবা- মা যেন অস্থির হয়ে উঠেছিল। কিছুটা অবাক হয়েছিল সোলাঙ্কি, ও কি তাহলে বাবা- মা’র কাছে বোঝা হয়ে গেল? নাকি সব মেয়েদের বাবা-মা দের এমনই অভিব্যক্তি হয়। দাদা, বৌদি আর বাবার সাথে তাকে দেখতে এসেছিল প্রিয়াষিশ সরকার।

কর্ন বিদারক হর্নে চোখ তুলে দেখল সিগনালে লাল আলোর পরিবর্তে সবুজ তীর চিহ্ন ফুটে উঠেছে। গিয়ার বদলে গাড়ির গতি বাড়ালো সোলাঙ্কি। ও দেখতে মোটামুটি ভালোই, তবে একটু স্থুলকায় বলা চলে। কত বছর আগের স্মৃতি, তবু এখনো অমলিন। জুলাই মাসের সেই রবিবারে প্রথমবারের জন্য পাত্রপক্ষের সামনে বসেছিল সে। যত স্মার্ট মেয়েই হোক না কেন, একটু টেনশন তো হয়’ই। তার ওপর পাত্র আবার কলেজের অধ্যাপক। এমনিতেই এই টিচার টাইপের ছেলেদের কোনোদিন পছন্দ হতো না সোলাঙ্কির। যখন দুজনের একান্তে কথা হয়েছিল সবকিছুর আগে সোলাঙ্কি জানিয়েছিল চাকরি কিন্তু সে ছাড়তে পারবে না। প্রায় আধঘন্টা কথা বলার পর সোলাঙ্কির মনে হয়েছিল একটু মেনে আর মানিয়ে নিলে এমন একজন সহজ সরল মানুষের সাথে সারাজীবন কাটানো যায়। কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে ঘড়ির দিকে তাকাল সে। আরো মিনিট পনেরো-কুড়ি লাগবে মনে হচ্ছে পৌঁছাতে, কে জানে ওখানে কি হচ্ছে। একটা ফোন করবে নাকি পিউ কে? না থাক। আজ কি হয়েছে সোলাঙ্কির? শুধু পুরানো কথা মনে পড়ছে। কোনো কিছু অঘটনের লক্ষণ নয় তো? মনে মনে একবার ঈশ্বরকে স্মরন করে নিল সে। বিয়ের প্রায় বছর দুয়েক পর এক রাতে প্রিয়াষিশের বুকে মাথা রেখে আবদারের সুরে বলেছিল,” আমরা যদি আলাদা থাকি, তোমার কি খুব সমস্যা হবে?” প্রিয়াষিশের গলায় বিষ্ময়,” কেন? কেউ কিছু বলেছে? মা বা বৌদি? দেখো আসলে…” প্রিয়াষিশের ঠোঁটে তর্জনি রেখে চুপ করিয়ে দিল। “না কেউ কিছু বলেনি, মানে আজ বলেনি। “উঠে বসে প্রিয়াষিশ বলেছিল, ”মানে?” সোলাঙ্কি ওর কাঁধে মাথা রেখে বলে,” দেখো আমি চিরকাল একা একা বড় হয়েছি,স্বাধীন ভাবে। ওনারা অনেক অ্যাডজাষ্ট করছেন আমি জানি। এই যে আমি দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকি দিদিভাই একা ই সংসারের বেশিরভাগ টা সামলায়, তার ও তো কোনো একদিন বিরক্তি আসতে পারে। আমি ও চেষ্টা করছি অ্যাডজাষ্ট করার,কিন্তু আমার নিজের ওপর’ই ভরসা হয়না, যদি আমি এবাড়ির কারোর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। তাছাড়া একান্ত আমাদের দুজনের সংসার হবে, মন্দ কি? আসা-যাওয়া তো থাকবেই। কিগো কিছু বলো?” শেষ কথাটা বেশ আদুরে গলায় বলল সোলাঙ্কি। “আচ্ছা ভেবে দেখি” বলে শুয়ে পড়েছিল প্রিয়াষিশ। তার ৮ মাস পর বিডন স্ট্রিট এর ফ্ল্যাটে ওদের নতুন সংসার পাতা,একান্ত ওদের দুজনের সংসার। তার দুবছর পর ওদের দুজনের মাঝে এলো ছোট্ট ফুটফুটে পিউ, ধীরে ধীরে ওর বেড়ে ওঠা, সোলাঙ্কির প্রোমোশান, প্রিয়াষিশের বিভাগীয় প্রধান হওয়া, সব মিলিয়ে বেশ সুখের সংসার ছিল ওদের। দুজনের নামের সাথে নাম মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিল ‘প্রিয়াঙ্কি’। একটা গর্তে পড়ে গাড়িটা একটু দুলে উঠতে বাস্তবে ফিরল সোলাঙ্কি। একটু হলেই ফুটপাতের ধারে দাঁড় করানো একটা বাইকে গিয়ে লাগত। আজ বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। গাড়ি চালানোর সময় এমনটা হয়না সোলাঙ্কির। তাই মনটা আরো কু ডাকছে। গাড়ি সামনে এগোতে গিয়ে বুঝল এসে গেছে। রাস্তার বাঁকটা চিনতেই পারেনি। একটা নতুন ফ্ল্যাট উঠছে। সত্যি এই ক’দিনে কত কি’ই বদলে যায়। যেখানে যাচ্ছে সেটাও কি আগের মতোই আছে, নাকি বদলে গেছে। গাড়ি এসে থামল পাঁচতলা যে বাড়িটার সামনে তার নাম আনন্দ নিকেতন। নামটা খুব পছন্দের ছিল সোলাঙ্কির। ফ্ল্যাট নম্বর ৪০২। লিফ্টে উঠে একবার দুহাত কপালে ঠেকালো সোলাঙ্কি, কে জানে গিয়ে কি দেখতে হবে।

সোলাঙ্কি - Image of a crying women  দুবার ডোরবেল বাজানোর পর’ও দরজা খুলল না। কি হল? চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল সোলাঙ্কির। ব্যাগ ঘাঁটতে শুরু করল, কে জানে কি ভেবে এখনো রেখে দেয় একটা ডুপ্লিকেট চাবি। হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। একি এতো অন্ধকার কেন ভিতরে? হলে তো সারারাত একটা ছোট আলো জ্বলত। অবশ্য আগের সাথে তুলনা না করাই ভালো। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছে না কেন? কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল, ‘পিউ। ‘একবার ঢোঁক গিলে ডাকল, ‘প্রিয়।‘ চোখর কোণে আটকে থাকা জলের কুঁচিগুলো গাল বেয়ে নেমে এলো। কতদিন পর আবার ডাকল এই নামটা ধরে। শাশুড়িমা বলতেন, “বৌমা স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই, অমঙ্গল হয়।“ আলাদা হওয়ার পর সেসব আর মানে নি। কিন্তু বাবা- মেয়ে গেল কোথায়? কিচেন থেকে দৌড়ে আসা মেয়ের সাথে অন্ধকারে ধাক্কা খেল সোলাঙ্কি। পিউ- র হাতে থাকা গ্লাসের সব জল সোলাঙ্কির গায়ে পড়ল। প্রিয়াঙ্কি চটপট বলল, “মা সরি সরি।“ মেয়েকে ধরে সোলাঙ্কি কান্না ভেজা গলায় বলল, “তোর বাবা…” কথা শেষ হওয়ার আগেই পিউ বলল, “মা আগে তুমি জামাটা ছাড়ো, পুরো ভিজে গেছে। এমনিতেই তোমার ঠান্ডা লাগার ধাত।“ মানে কি বলছিস? ভিজুক জামা। আগে প্রিয়…” অবাক স্বরে বলল সোলাঙ্কি। “তোমার ঠান্ডা লাগলে কে দেখবে মা, তুমি তো একা থাকো।“ মেয়ের কথাটা যেন সূচের মতো বিঁধল বুকে। সত্যিই তো সে একা, বড্ড একা। “তোমার সব জিনিস গেস্টরুমে রাখা আছে, বদলে জলদি বাবার ঘরে চলে এসো।“- বলে আর দাঁড়াল না প্রিয়াঙ্কি। গেস্টরুম? কানে যেন বাজল শব্দটা। মাত্র ১ বছরে ও এই বাড়ির গেস্ট হয়ে গেল? আর বাবার ঘর? একদিন সেই ঘরটা ওর’ও ছিল। প্রিয় না হয় সব ভুলে গেল, কিন্তু মেয়ে? সেও আমাকে এই সংসারের বাইরে করে দিল? তিল তিল করে এই বাড়ি, এই সংসারটাকে মনের মতো করে সাজিয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ২৪টা বছর যে এভাবে অতীত হয়ে যেতে পারে সেটা ভাবতে গিয়ে কান্নাটা বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে উঠল। বুকের ব্যাথাটা ওর হল না কেন? ও চলে গেলে বাবা- মেয়ে কারোর’ই তো কিছু… কান্নায় গলা বুজে এলো সোলাঙ্কির। এবার ভিজে শরীরে ঠান্ডাটা বেশ অনুভূত হচ্ছে। প্রায় দৌড়ে গেস্টরুমে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করল সে। আলো জ্বেলে একটু অবাক হল সোলাঙ্কি। ঘরটা ঠিক তেমনই আছে, যেমনটা রেখে গেছে। কিন্তু ওর জিনিস? হয়তো আলমারিতে বন্দি হয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুলে দেখে সেটাও তো ফাঁকা। পিউ যে বলল… হঠাৎ ওপরের তাকের কোনায় দেখল একটা শাড়ি রাখা, সাথে পেটিকোট ও ব্লাউজ। হাতে নিতেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। একটা গোলাপি ঢাকাই শাড়ি। এই শাড়িটা ওর ছিল বলে তো একটুও মনে পড়ছে না। তবে ঢাকাই ওর প্রিয় শাড়ি, মানে ছিল। আর গোলাপি… প্রিয় বলত গোলাপি শাড়িতে সোলাঙ্কিকে নাকি এক অন্যরকম সুন্দর লাগত। নিজের কথাটা যেন নিজেরই কানে লাগল। বলত? কি করে সব এমন past tense হয়ে গেল? চোখের জল আবার দু’গাল বেয়ে নেমে এল সোলাঙ্কির। পিউ দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “মা প্লিজ তাড়াতাড়ি একবার বাবার ঘরে এসো।“ কান্নাভেজা গলায় সোলাঙ্কি উত্তর দিল, “আসছি”। দ্রুত হাতে শাড়িটা পড়তে লাগল। না আর কিছু ভাববে না। ওর যেটুকু কর্তব্য করে যত তাড়াতাড়ি হয় ফিরে যাবে। এমনিতেও রাত বাড়ছে।

ওদের বেডরুমে প্রায় দৌড়ে গেল সোলাঙ্কি, সরি প্রিয়’র ঘর। ওদের ছিল একসময়। কিন্তু প্রিয় কই? ও যে অসুস্থ। ওর তো এই ঘরেই থাকার কথা। পিউ কি এই রাত বিরেতে ওর মায়ের সাথে ইয়ার্কি করছে? ডাকতে যাবে মেয়েকে এমন সময় চোখে পড়ল খাটে কি যেন রাখা। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল একটাই অক্ষর লেখা “সু”। হাতের লেখাটা যে প্রিয়’র সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই সোলাঙ্কির। আর ‘সু’ এই নামে ওকে পৃথীবিতে এই একটা মানুষই ডাকে, মানে ডাকত। কিন্তু চিঠি লেখার কি ছিল? অসুস্থতায় কি বেশি ভাবছে? কিন্তু মানুষটা গেল কোথায়? চটপট চিঠিটা পড়তে শুরু করল সোলাঙ্কি।

“তুমি আমায় বোঝার চেষ্টাই করলে না একটুও, জানতে চাইলে না কিছু। বিনা দোষে আমায় এতোগুলো দিন ধরে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ। জানি হয়তো কষ্ট তুমিও পাচ্ছ।“ চোখে মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। আজ ১ বছর পর হঠাৎ প্রেম জাগ্রত হয়ে উঠল কেন? এতদিন তো এই কথাটা শোনার অপেক্ষাতেই ছিল সে। মাথাটা নীচু করে নিল সোলাঙ্কি। মনে মনে ভাবল, কথা বলার চেষ্টা তো ও নিজেও করেনি। এতবছরের সম্পর্ক, কথা বললে হয়তো আরো আগেই… পিউ যে বলেনি তা নয়, কিন্তু অভিমানটা বড় তীব্র ছিল। হতে পারে ওদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, কিন্তু প্রিয় তো জানে সোলাঙ্কির কি পরিমাণ অধিকারবোধ ওর ব্যাপারে। আবার পড়তে শুরু করলো। যে ফোনটা আসা নিয়ে এতকিছু হলো, সেটা সত্যি রং নম্বর ছিল। আমি আজও সত্যি জানিনা মেয়েটা কে। তুমি কি করে ভাবলে যে বিয়ের দীর্ঘ ২৪ বছর পর আমি নতুন করে অন্য কারোর প্রেমে পড়তে পারি? তুমি জানো না আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি? তুমি শুনলে অবাক হবে যে মেয়েটির ফোন আসত সে আমাদের পিউ এর থেকেও ছোট।

তুমি এখনো জানো না কি হয়েছিল সেদিন। মনে আছে সেই রাতে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম প্রায় সাড়ে ১০টা নাগাদ। সেদিন কলেজে ছাত্র সংসদের কিছুজন আমায় ঘেরাও করে রাখে, ফেল করা ছাত্রদের পাশ করানোর দাবীতে। তুমি জানো যে আমার কিছু এথিক্স আছে। অন্যায় দাবী আমি কখনো মানিনা। এক ছাত্র সেদিন আমার গায়ে হাত তুলতে গিয়েছিল। ভাবতে পারছ শিক্ষক হিসাবে আমি কতটা ব্যর্থ। আমরা শুধু ডিগ্রী দিচ্ছি, মানুষ গড়তে পারছি না। কতৃপক্ষের অনুরোধে আমি সেদিন কিছুজনকে পাশ করাতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার মতো আমার এথিক্সও সেদিন হেরে গিয়েছিল সু। গাড়ি করে বাড়ি ফেরার সময় মনে মনে ভাবছিলাম, পিউ ও তো কলেজে পড়ে, সেও কি তার প্রফেশারদের সাথে এমন ব্যবহার করে? একজন ব্যর্থ শিক্ষক হয়ে কোনোরকমে চোখের জল লুকিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম, কারন বিয়ের পর থেকে তুমি ছাড়া আমি কারোর সামনে…. যাক সে কথা, সেদিন সেই সুযোগও তুমি আমায় দাও নি। বাড়ি ফিরতেই তুমি আবার শুরু করলে, সেই মেয়েটি নাকি ফোন করে জানতে চেয়েছিল, আমি বাড়ি ফিরেছি কিনা। ধরে নিলে আমি তার সাথেই ছিলাম। একবারও মনে হলোনা প্রিয় পৃথীবিতে একমাত্র তোমার দেওয়া নাম নয়। আমি মেয়েটির সাথে পরে কথা বলেছিলাম, ও যাকে খুঁজত তার নাম প্রিয়ম। জানিনা কিভাবে তার কাছে আমাদের ল্যান্ডলাইনের নম্বর এল। সেই রাতের পর সেই ফোন আর আসেনি। তোমার প্রশ্নবাণে আমার হতাশা রাগে পরিনত হয়েছিল। বলেছিলাম আমি যে, হ্যাঁ সম্পর্ক আছে, কি করবে তুমি? আর তুমি মেনে নিলে? এককথায় অত রাতে বাড়ি ছেড়ে, আমায় ছেড়ে চলে গেলে। জানি আমি আটকাতে পারতাম, আজকের কথা গুলো তোমায় সেদিন বলতে পারতাম, তাহলে হয়তো মাঝের এই বছরটা দুটো আলাদা সংসার হতো না, কিন্তু অসম্ভব রাগ হয়েছিল তোমার ওপর। আমাকে দেখে তুমি একবারও বুঝলে না আমার ভিতরে কি পরিমান ঝড় চলছে। শুধু মুখের কথাটা শুনলে। যার কাছে আসব বলে চোখের জলও লুকিয়ে রাখলাম, সে আমার ভেঙে পড়াটা ২৪ বছর পরও বুঝতেই পারল না। সেদিন বুঝেছিলাম স্বামী হিসাবেও আমি ব্যর্থ। এতগুলো ব্যর্থতা আমি একসাথে মেনে নিতে পারিনি সেদিন। আমি সেদিন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু পিউ? যে আমার জন্য রয়ে গেল? তাই আর… তুমি তো জানোই আমি খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ। জানি পিউ এর ওপরও তোমার অভিমান কম নয়, কিন্তু এমন নয় যে ও আমায় বেশি ভালোবাসে। তোমার মেয়ে তোমার সংসার সামলাতে থেকে গিয়েছিল সেইদিন, যাতে তুমি যখনই ফেরো, তোমার সংসার আগের মতোই থাকে। আসলে সত্যি বলতে আমরা দুজনেই ভাবিনি, তুমি আমাদের ছাড়া এতগুলো দিন থাকতে পারো।সোলাঙ্কি - Holding hands

কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে পড়ল সোলাঙ্কি। বলল,” তুমি না প্রিয়, স্ত্রী হিসাবে আমি ব্যর্থ। আমি এতবছর থেকেও তোমায় চিনতে পারলাম না।“ হঠাৎ প্রিয়াশিষের গলা, “হ্যাঁ তুমিও ব্যর্থ।“ ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে সোলাঙ্কি দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে হালকা হাসি। মাথা নামিয়ে নিল সোলাঙ্কি। সামনে এসে দাঁড়াল প্রিয়াশিষ। কতদিন পর আবার দেখা। বলল, “বুড়ি হতে চললে তবু তোমার অকারন জেদ গেল না। জানি একবার ডাকলেই চলে আসবে, তবু নিজে থেকে কিছু বলবে না। উতলা সোলাঙ্কি জিজ্ঞাসা করল, “তোমার যে শরীর খারাপ, কেমন আছো?” প্রিয়াশিষ হেসে বলল, “যাক এখনো কেয়ার করো তাহলে। ভয় নেই এখুনি মরব না।“ সোলাঙ্কি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, প্রিয়াশিষ সোলাঙ্কির হাত দুটো ধরে বলল, বাবা হিসাবে আমি ব্যর্থ হতে চাইনা সু। স্ত্রীয়ের জিজ্ঞাসু চোখের সামনে তুলে ধরল একটা ফটো। অবাক সোলাঙ্কি বলল, “কে ছেলেটি?” প্রিয়াশিষ বলল, “রঙ্গিত বর্মন। তোমার মেয়ের ভালোবাসার মানুষ।“ সোলাঙ্কি বলল, “তমি কি করে জানলে? পিউ এর ওপর নজরদারি করছো?” প্রিয়াশিষ বলল, “না। বাবা হিসাবে মেয়ের মন খারাপের কারন খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি, আমাদের আলাদা থাকা ওদের সম্পর্ককে নষ্ট করছে। পিউ ছেলেটির সাথে সম্পর্ক রাখতেও পারছে না, ভাঙতেও পারছে না। সু আমরা পারিনা আমাদের ইগো, অভিমান এগুলো সরিয়ে রেখে পিউ এর জন্য আবার একসাথে থাকতে? যদিও আমার ক্ষেত্রে দুটোর কোনটাই নেই, আছে শুধু অপেক্ষা।“ সোলাঙ্কি চোখের জল মুছে বলল, “পিউ এত বড় কবে হলো প্রিয়।“

বাইরে থেকে পিউ এর গলা, “সব কথা কি এখনই শেষ করবে? কিছু বাকি রাখো। আজ কিন্তু সারারাত পার্টি চলবে।“

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *