এই স্থানে গিয়ে আমার দুটো গান মনে এসেছিল। তবে নীল রং ছিল নয়, নীল রং এখনো আমার প্রিয় আছে, আর নীল সাগরের জলে সত্যিই যেন স্বপ্নেরা ডানা মেলে। আমি যে জায়গার কথা বলছি, সেটা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি ছোট্ট দ্বীপ নীল। যদিও ২০১৭ তে বর্তমান সরকার এই দ্বীপের নামকরন করেন শহীদ দ্বীপ, তবে পর্যটকদের কাছে আজও তা নীল আইল্যান্ড হিসাবেই বেশি আপন। ২০১৯ এর জুলাই মাসে আমরা গিয়েছিলাম আন্দামান ঘুরতে। আন্দামান গেলে নীল আইল্যান্ড যাবো না, তাই আবার হয় নাকি? আন্দামানের রাজধানী ও মূল শহর পোর্টব্লেয়ার থেকে নীল আইল্যান্ডের দূরত্ব ৫৪ কিমির কাছাকাছি। তবে এখানে তো শুধুই জলপথ। সময় লাগে ওই দেড়ঘন্টার মতো। সরকারি ফেরী যেমন আছে তেমনই আছে বিলাসবহুল ছোট জাহাজ। আমরা যদিও গিয়েছিলাম হ্যাভলক থেকে। সরকারি ফেরীতে সময় লেগেছিল ১ ঘন্টা। আমরা নীল আইল্যান্ড পৌঁছেছিলাম দিনের শেষ বেলায়।
এই ছোট্ট দ্বীপে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল লক্ষণপুর সমুদ্র সৈকত। তার কারণ এখানের দুটি আকর্ষন – প্রথম এখানে অবস্থিত স্বাভাবিক সেতু আর দ্বিতীয় সূর্যের বিদায়বেলার দৃশ্য। এই স্বাভাবিক সেতু বা Natural Bridge আমার কাছে নীলের তো বটেই, পুরো আন্দামানেরই অন্যতম সেরা দ্রষ্টব্য। সমুদ্রের ঢেউ তে ভেসে আসা মৃত কোরাল জমতে জমতে তৈরি হয়ে গেল একটা বৃহদাকার সেতু। আর সেই সেতুর তলদেশে বহমান সমুদ্র স্রোতে বাস করে অনেক অনেক সামুদ্রিক প্রাণী, যাদের অনেকের সাথে সেটাই ছিল আমাদের প্রথম দেখা বা প্রথমবার তাদের নাম শোনা। তবে এই জায়গা ঘুরে দেখতে গেলে দিনের কিছু বিশেষ সময় যেতে হবে। জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে এখানে পর্যটকের আনাগোনা। সবচেয়ে ভালো সময় ভাটার শেষ দিক। ভাটার সময় জল কম থাকে, তাই সুন্দরভাবে দেখা যায় জলের তলায় লুকিয়ে থাকা জীবন্ত প্রাণগুলি। ওখানে না গেলে এদের সম্পর্কে অনেক কিছুই থাকত অজানা, অনেকেই থেকে যেত অচেনা প্রাণীর তালিকায়। তবে অবশ্যই প্রয়োজন একজন স্থানীয় গাইড, যার সহায়তায় আপনি দেখতে পাবেন রকমারি জীবন্ত কোরাল। এই যেমন, মগজাকৃতি কোরাল (Brain coral), অঙ্গুলাকৃতি কোরাল (Finger Coral), বর্ন পরিবর্তনকারী কোরাল ( Color Changing Coral),
মৌচাক আকৃতির কোরাল (Honey Comb), জীবন্ত শঙ্খ, জবন্ত ঝিনুক আরো কত কি। সবের নামও হয়তো আর এখন মনে নেই। যখন সেইসব জীবন্ত শঙ্খ বা ঝিনুক হাতে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়, তখন কে আর সেই সুযোগ ছাড়ে। তবে এতো কিছু দেখার পরেও আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করছিল সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ওই একলা সেতু, যায় পদতলে এসে সাগরের ঢেউ গুলো চুম্বন করে যাচ্ছে। আর সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব সুর। আস্তে আস্তে যখন জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করবে, ফিরে আসতে হবে তীরের কাছে, আর সেখানে দাড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয় আকাশের দিকে। একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে আকাশের রং। আসমানি রঙে মিশতে থাকে কমলার আভা আর প্রকৃতি যেন লজ্জারাঙা হয়ে ওঠে নববধূর মতো। সেই দৃশ্য আমরা উপভোগ করেছিলাম নীরবে। সত্যি প্রকৃতির এই রূপ, এই রঙ না দেখলে তো জীবন বৃথা। তবে আরো ভালো হতো যদি স্তব্ধ হতো ঘড়ির কাঁটা। কারন সন্ধ্যা এসে বুঝিয়ে দিয়েছিল, এবার তোমরা ফিরে যাও।
‘হাওয়া বিল নেস্ট’, নীল আইল্যান্ডে আমাদের এক রাতের আস্তানা ছিল এই সরকারি লজ। সরকারি লজ যে এতো সাজানো হবে, এমন সুন্দর হবে আমরা ভাবিনি। যদি কেউ এই আইল্যান্ডে থাকার হোটেল খোঁজেন, তাহলে হাওয়া বিল নেস্ট আপনাদের একটি বিকল্প হতেই পারে।
লক্ষণপুর সমুদ্র সৈকত ছাড়াও এই আইল্যান্ডে আছে ভরতপুর ও সীতাপুর সৈকত। সীতাপুর সমুদ্র সৈকত সূর্যোদয়ের জন্য বিখ্যাত, যা আমাদের অদেখা থেকে গেল মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারনে। আর ভরতপুর বিখ্যাত বিভিন্ন water activity, যেমন scuba diving, snorkeling, banana boat ride, glass bottom boat ride, jet skiing ইত্যাদির জন্য। যদিও আমরা তেমন বিশেষ কিছু করিনি, কারন scuba আমরা হ্যাভলকে এবং glass bottom boat ride আমরা নর্থ বে আইল্যান্ডে আগেই সেরে ফেলেছিলাম। কিন্তু দেখাশোনা তো ফ্রি। তাই হালকা রোদের তাপ অনুভব করতে করতে আমরা দিব্যি দুপুরটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম এই ভরতপুর বীচে সাগরের নীল জলে দৃষ্টিপাত করে।
তবে একটা বিষয় হল, নীল আইল্যান্ড এবং হ্যাভলক আইল্যান্ড কিন্তু বেশ খরচ সাপেক্ষ। মানে আমাদের মতো কলকাতাবাসীর কাছে তা বেশ অনুভব যোগ্য।
আন্দামান সমগ্র ভ্রমনটাই আমার কাছে চিরস্মরনীয়, তার ওপর একটা অন্য মাত্রা এনেছিল নীল দ্বীপ ও সেখানে অবস্থিত সেই সেতু।
পাঠকদের বলছি, যদি ভারত ভ্রমনের বাকেট লিস্ট বানাতে চান, তাহলে আন্দামানকে রাখতেই পারেন। আর যদি আন্দামান ঘুরে দেখা হয়ে যায় তাহলে আমায় জানাবেন আপনার প্রিয় স্থানটি? আমি কিন্তু শুনতে খুব আগ্রহী। আপনার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে অথবা অন্য কোন মতামত জানাতে ক্লিক করুন অনুলিপির যোগাযোগ পেজে।
হয়তো মনস্থির করেই ফেলেছেন এবার আন্দামান ঘুরেই আসবেন। তাহলে একটু সময় নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতেই পারেন নীল আইল্যান্ডের উইকিপিডিয়া তে।