দেখতে দেখতে আজ পঞ্চমী হয়ে গেল, কাল দূর্গা মায়ের বোধন। মর্তে মা দূর্গা এলো বলে। বেশ কিছু বছর ধরে বাতাসে ওই পূজো পূজো গন্ধটা যেন আর পাই না। অবশ্য আজকাল যা দূষণ বেড়ে গেছে, তাতে সব ভালো গন্ধই চাপা পড়ে যায়। আমার আবার পূজো! আমি তো মনে মনে স্থির করেই নিয়েছি সব মায়া ত্যাগ করবো। কিন্তু সমস্যা হল হিতাংশুর মায়া যে কিছুতেই কাটাতে পারছি না। আমাকে ছাড়া ও একটা দিন ও কল্পনা করতে পারে কিনা সন্দেহ, আমি’ও কি আর পারি? হিতাংশু এই জুলাইতে ৪২ পেড়োলো, এখনো সময় যে একদম নেই তা নয়। ২ বছর ধরে তো বলছি ডিভোর্স দাও আমায়, সে তো হেসেই উড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে নিজের ওপর এতো রাগ হয়, পৃথিবীতে তো এতো মেয়ে আছে, আমি কেন ওই না পারার দলে? আর যদি তাই হয়’ও, কেন সেই অক্ষমতা মেনে নেওয়ার মতো মনের জোর নেই আমার? কেন হিতাংশুর মতো যেটুকু আছে তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিতে পারিনা আমি? এই এতোগুলো কেন’র কোনো উত্তর আমি পাই না। ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটায় সাড়ে ছ’টা বাজে। না উঠে রেডি হই। মহাশয়ের আদেশ সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে সেজেগুজে তৈরী থাকতে হবে। আবার শাড়ীও ঠিক করে রেখে গেছে। যত আদিখ্যাতা। দূর্গা পূজা নিয়ে বাঙালিদের চিরকালই বাড়াবাড়ি। পঞ্চমী থেকে এই বুড়ো বয়সে কে বেড়োয়? কিন্তু হিতাংশুর উচ্ছাসের সামনে কি আর না বলা যায়? হয়তো এটাই শেষবার।

তিন – চারটে ঠাকুর দেখে সৌরভীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে ঢুকলাম। আজ বাইরে খাওয়া আর ঠাকুর দেখা আমার উদ্দেশ্য তো আর নয়। কিন্তু চারদিন আগে যা দেখলাম, তার ভীতি মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। প্রতিটা মুহুর্ত মনে হয় কিভাবে খুশি রাখতে পারব ওকে। সৌরভীর ডাকে চিন্তার জাল ছিড়ে গেল। “কিগো এখানে আমরা বসে থাকতে এসেছি? অর্ডার করবে না কিছু?” দুশ্চিন্তাকে দূরে সরিয়ে বললাম, “হ্যাঁ দেবো তো। তুমি দেখো, বলো কি খাবে? আজ আমি তোমার পছন্দ মতো অর্ডার করবো।““কেন?” সৌরভীর প্রশ্নে একটু হোঁচট খেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, “না আর যদি এমন দুজনে বেড়োনোর সুযোগ না পাই।“ কথাটা কানে যেন তীরের মতো বিঁধল  সৌরভীর। মনে মনে ভাবল ‘ তাহলে কি হীতাংশু আমায় ছেড়ে থাকতে মন থেকে প্রস্তুত? আমিও তো এটাই চাই। যাক আমার পিছুটান একটু হলেও কমলো। কিন্তু চোখে জল আসছে কেন?’ সৌরভীর চোখের কোণে জল দেখে মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। তাহলে হীতাংশু রায় এর অভিনয় ক্ষমতায় এখনো পুরোটা জং ধরেনি। আরো কয়েক ঘন্টা অভিনয়টা আমায় ঠিক মতো চালিয়ে যেতেই হবে। মনে মনে বললাম সরি ম্যাডাম। আর মা দূর্গাকে স্মরন করে বললাম কাল যেন সব প্ল্যান মতো হয় মা। খাবারের অপেক্ষা করতে করতে সৌরভী হঠাৎ বলল, “আজ হিতৈষী এসেছিল। অনেকক্ষন ছিল। “মেনুকার্ড ওলটাতে ওলটাতে বললাম, “ও আচ্ছা।“ সৌরভী তৎক্ষনাত প্রশ্ন, “তুমি কি জানতে ও আসবে?” এইরে আর একটু অবাক হওয়ার এক্সপ্রেশান দেওয়া উচিৎ ছিল। সামাল দিতে বললাম, “আমি কি করে জানবো? আর জানলে তোমায় বলতাম না? বোন তো তার দাদার বাড়ি আসতেই পারে।” সৌরভীর মন থেকে সন্দেহটা যে যায়নি, সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হাজার হোক ১৪টা বছর আমার সাথে কাটিয়ে ফেলেছে। যাক যা হয়ে গেছে, গেছে, এরপর থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কাল ভোর হওয়ার অপেক্ষায় আছি শুধু আমি। অনেক বড় একটা রিস্ক নিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সৌরভীর যে পাগলামির লক্ষন দেখলাম তারপর এটুকু রিস্ক তো আমায় নিতেই হতো। তবে একথা সত্যি সৌরভীর মা আর আমার বোন এর সাহায্য ছাড়া সম্ভব হতো না কিছুই। আবার সৌরভীর প্রশ্নবাণ। “কি হয়েছে তোমার আজ? খাবে নাকি চুপচাপ বসেই থাকবে?” না না সৌরভীকে আর কোন সন্দেহ করার অবকাশ না দেওয়াই ভালো। মজা করতে বললাম, “তুমি খেলেই আমার পেট ভরবে।“ “ নাটক” বলে হাসল, কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রভ।

বোধনের সকাল

সকাল প্রায় ৬টা। ঢাকের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। মা দূর্গা এল তার বাপের বাড়ি। মনে মনে ভাবলাম আমার কতদিন মা’এর কাছে যাওয়া হয়নি। বাপের বাড়ি বলতে ওই একটি মানুষ’ই তো আছে। আজকাল যেন কিছুই ভালো লাগেনা, ধুর। হীতাংশু এখনো ঘুমাচ্ছে।

 

দূর্গা - Image of a mother holding her child

হঠাৎ ঘুম ভাঙল সৌরভীর ডাকে। ডাক না বলে সেটাকে চিৎকার বলাই ভালো। তাড়াতাড়ি উঠে দালানে এসে দেখি সৌরভীর চোখে জল আর দুহাতে জাপটে ধরা একটি ছোট্ট শিশু। আমায় দেখে বলল, “দরজাটা বন্ধ করো জলদি, কুকুরটা ঢুকে আসবে। দেখো কেমন আঁচড়ে দিয়েছে হাতে।“ তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, কই দেখি, তোমায় কোথায় আঁচড়ে দিল? “আমার না, এর” বলে হাতের শিশুটির দিকে ইঙ্গিত করল। আমি প্রথম দেখার ভান করে বললাম, “একি কে এটা?” সৌরভী কিছু বলার আগেই বেল বেজে উঠল। আমি বললাম কার না কার বাচ্ছাকে নিয়ে এসেছো, ফেরত নিতে এসেছে, বলে দরজার দিকে এগোতে এগোতে দেখলাম ও বাচ্ছাটিকে আরো নিজের বুকের মধ্যে চেপে নিল। দরজা খোলার শব্দে তাকিয়ে নিজের মা’কে দেখে দৌড়ে এল সৌরভী, “মা আমি আজ’ই তোমার কথা ভাবছিলাম। দেখো আমার কাছে কে এসেছে।“ আমি সাথে সাথে বললাম, “দেখুন আপনার মেয়ে কার না কার বাচ্ছা নিয়ে চলে এসেছে।“ সৌরভী কান্নাভেজা গলায় বলল, “না ও আমার। আমি সদর দরজায় জল দিতে গিয়ে দেখি ও শুয়ে ঘুমাচ্ছে আর একটা কুকুর ওকে শুঁকছে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে তুলে নি। অবশেষে আমার ঘরে দূ্গা এল, বলো মা। মনে মনে ভাবলাম বোন ঠিক’ই বলেছিল, একটি শিশুকে একবার কাছে পেয়ে সৌরভী আর ছাড়তে চাইবে না। তবু আমার মনে সংসয় ছিল, কারন ওর দত্তক নেওয়ায় খুব অনিহা। তবু সৌরভীর আত্মহননের প্রবনতা দেখে আমায় এইটুকু নাটক করতেই হলো। ওর মত ছাড়াই দত্তক নিতে হল। ওকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য রাগত স্বরে বললাম, “বাড়িটা আমার’ও। কার না কার বাচ্ছা। তুমি’ই বলো তো। যার জন্য এতদিন আমি সন্তান সুখ পাই নি। তুমি দত্তক নিতে চাওনি। আজ কি হল? দরকার কি আর? দাও আমি ওকে থানায় জমা দিয়ে আসি। বলে এগোতেই সৌরভী দু’পা পিছিয়ে গেল। ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মা তুমি বোঝাও প্লিজ ওকে। আমি তো দত্তক নিইনি, ও তো নিজে এসেছে।“ আমি দু পা এগিয়ে বললাম, “দেখো বাড়াবাড়ি করো না, আমি কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না। সৌরভী শিশুটিকে নিয়ে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। চেঁচিয়ে বলল, ও আমার মেয়ে, আমার। বন্ধ দরজার বাইরে আমি আর শাশুড়ি মা তখন হাসছি। মাইকে গান ভেসে আসছে, ‘বলো বলো দূর্গা এলো।

আপনারা যদি ছোটগল্প পড়তে ভালোবাসেন, তাহলে অবশ্যই পড়ুন স্বীকারোক্তি

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *