সোনালী অনেকক্ষন থেকে লক্ষ্য করছে ছেলেকে। বিরক্ত হয়ে বলল, “কিরে খাবারটা খাচ্ছিস না কেন? পেট ভর্তি? বাইরে খেয়ে এসেছিস?” ঋতম কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কোনরকমে খাবারটা গিলতে লাগল। পিয়ব্রত এতক্ষন চুপচাপ ছিল, এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “অফিসে কিছু সমস্যা হয়েছে? মুখটা তোর এমন শুকনো লাগছে কেন?” ঋতম একবার বাবার দিকে ফিরে তাকাল। বুকটা কেঁপে উঠল প্রিয়ব্রতর, কারণ ছেলের এমন চাহনির সাথে সে পরিচিত না। আজই সে ছেলেকে আর মেঘাশ্রীকে একসাথে দেখেছে। মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল। তাহলে ছেলের মুখটা এমন অমাবস্যার রাত কেন? মেঘাশী কি ওকে বিয়ে করতে চায় না? ও কি মানুষ চিনতে ভুল করল? বড্ড চাপ সৃষ্টি করল ছেলেটার ওপর? সোনালী এবার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল, “তোমার আবার কি হলো? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিছু না।“ সোনালী এবার ছেলের উদ্দেশ্যে বলল, “তোর সাথে একটা কথা ছিল। তোর মাসিমনি ফোন করেছিল। আগামী রবিবার তোর একটু সময় হবে?” ঋতম মাথা না তুলেই বলল, “কেন” সোনালী একটু হেসে বলল, “আসলে তোর মাসিমনি তোর জন্য একটা ভালো মেয়ে দেখেছে। মেসোর বন্ধুর মেয়ে। তাই বলছিল আগামী রবিবার যদি….” ঋতম বলল, “তুমি মাসিমনিকে বারণ করে দাও, এসবের আর প্রয়োজন নেই।“ প্রিয়ব্রত সাথে সাথে বলল, “হ্যাঁ সেইতো। আমি তো ওর জন্য পাত্রী দেখেই রেখেছি। আর আমি যতদূর জানি বাবানেরও পছন্দ।“ বলে প্রিয়ব্রত একবার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা বোঝার চেষ্টা করল। সোনালী বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার দেখা মানে তো ওই বাপ – মা মরা মেয়েটা।“ একটু চড়া সুরে প্রিয়ব্রত বলল, “তাতে কি? তোমার দিদির দেখা মেয়ের থেকে অনেক ভালো হবে এটা আমি নিশ্চিত।“ সোনালী বাঁকা সুরে বলল, “হ্যাঁ তুমি’ই তো মানুষ করেছো।“ ঋতম আর সহ্য করতে পারল না। খাবারের থালা ঠেলে উঠে বলল, “প্লিজ তোমরা থামবে?” জীবনে হয়তো প্রথমবার বাবা-মা এর সাথে এতো জোর গলায় কথা বলল। কিন্তু মনে মনে শতচ্ছিন্ন একটা মানুষ নিজেকে আর কতক্ষন সামলে রাখতে পারবে। গলার স্বরটা নামিয়ে নিয়ে বলল, “না মাসিমনির আনা সম্বন্ধে আমার কোন আগ্রহ আছে, আর না বাবার দেখা সম্বন্ধে। একটা কথা আমি তোমাদের দুজনকেই জানিয়ে দিতে চাই যে আমি বিয়ে করবো না। কাউকেই না।“ প্রিয়ব্রত ছেলের একটা হাত ধরে বলতে চাইল কিছু, ঋতম তাকে বলতে না দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “না মানে না বাবা। আমার মনে হয় আমার জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত আমি নিজে নিতেই পারি। সেইটুকু অধিকার আমার আছে। আর দয়া করে কারনটা জানতে চেয়ো না, আমি বলতে পারবনা।“ আর দাঁড়ালো না সে। হাতটা ধুয়ে প্রায় দৌড়ে ওপরে চলে গেল।। কান্নাভেজা গলায় প্রিয়ব্রতর উদ্দেশ্যে সোনালী বলল, “এইসব তোমার জন্য হয়েছে। আরো ছেলের বিয়ে বিয়ে করে লাফাও।“ প্রিয়ব্রত আর উত্তর দেওয়ার জন্য দাঁড়াল না।

অন্ধকারে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ঋতমকে দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধে হেরে যাওয়া আহত এক নিঃসঙ্গ সৈনিক। কি এমন হল হঠাৎ? বুঝে উঠতে পারছে না প্রিয়ব্রত। ছেলের পাশে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কি সমস্যা? বাবাকে কি বলা যায় না?” আকস্মিক উপস্থিতিতে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারেনি ঋতম। চোখের জলটা মুছে বলল, “বাবা প্লিজ, একটু একা থাকার অধিকারও কি আমার নেই?” প্রিয়ব্রত ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “নিশ্চই আছে। আমিও তোকে স্পেস দিতে চাই। কিন্তু আমার হিসাব যে মিলছে না বাবান। “ঋতম জিজ্ঞাসা করল, “কিসের হিসাব?” প্রিয়ব্রত বলল, “আমি আজ বিকালে তোকে আর মেঘাশ্রীকে একটা কফি শপে ঢুকতে দেখলাম।“ ঋতম একটু দূরে সরে বলল, “আমি তো আগেই বলেছি আমি কোন কারণ বলতে পারব না। কিছু বিষয় অপ্রকাশিত থাকাই ভালো।“ প্রিয়ব্রত বোঝানোর সুরে বলল, “না না আমি তোকে বিয়ে না করার কারণ বলতে বলছি না। দেখ, মেঘাশ্রী তো ঋতম - Image of father and sonআমার পছন্দ করা মেয়ে। আমি ওর সাথে তোর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। তাই…” “না করালেই পারতে বাবা।“ আনমনে বলে উঠল ঋতম। প্রিয়ব্রত ছেলের কাছে গিয়ে বলল, “কেন মেঘাশ্রী কি তোর জন্য…” বাবাকে চুপ করিয়ে ঋতম বলল, “মেঘা খুব ভালো মেয়ে বাবা। ওকে এবার ছাড়ো। “ প্রিয়ব্রত অবাক হয়ে বলল, “মানে? মেঘাশ্রী খুব ভালো মেয়ে। তাহলে?” একটু চুপ থেকে বলল, “আজ যখন তোদের দুজনকে হাত ধরা অবস্থায় দেখলাম, মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম। ভাবলাম, হয়তো তোরা দুজন দুজনকে ভালো…” কথাটা শেষ করল না প্রিয়ব্রত। বাবার কথায় একটু একটু করে ফাটল ধরছে ঋতমের বুকের জমে থাকা পাথরটায়। ও চাইছে না তা ভেঙে পড়ুক, কিন্তু পারবে কি? মাথা নামিয়ে বলল, হয়তো না বাবা, সত্যি আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছি দু্র্ভাগ্যবশত।“ প্রিয়ব্রত যেন একটু আশার আলো দেখল। যদি ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ানো যায়। প্রিয়ব্রত ছেলের দুই কাঁধ ধরে বলল, “তাহলে বিয়ে করবি না কেন বলছিস? তোর মা মানছে না বলে?” এবার ছেলের চোখ ঝাপসা হতে দেখল প্রিয়ব্রত। ক্ষানিক চুপ থেকে ঋতম বলল, “এটা মেঘার সিদ্ধান্ত। আর আমি তাতে সহমত।“ প্রিয়ব্রত আরো অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল। ওর পছন্দ করা মেয়েকে ভালোবেসে ওর ছেলে সারাজীবন একা থাকব? বাবা হয়ে এটা মানা সম্ভব? কারণ তো ও জানবেই।  একটু গলা চড়িয়ে বলল, “কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত? আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে বাবান। ভালোবাসিস, বিয়ে করবি, তা না বিষয়টাকে অহেতুক জটিল করছিস তোরা।“ ঋতম যেন হালকা হাসল, বলল, “বিষয়টা যে আগে থেকেই জটিল হয়ে আছে বাবা।“ প্রিয়ব্রতর ধৈর্যের বাঁধ এবার একটু একটু করে ভাঙছে। গলা চড়িয়ে বলল, “কিসের এত জটিলতা তোদের?” ঋতম আর পারল না, কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, “কারণ মেঘা আমার বোন বাবা। আর ভাই-বোনে…” প্রিয়ব্রত ছেলেকে দু’হাতে ধরে বলল, “মানে? কিসব বলছিস? মেঘাশ্রী তোর বোন কি করে হয়?” ঋতম মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিল। ও স্থির করে নিয়েছিল এই বয়সে ও বাবাকে কোন আঘাত করবে না। কিছু জিনিস না বলাই ভালো। যা হয়ে গেছে তাকে এতবছর পর তো আর বদলানো যাবেনা। আর মেঘার পরিচয়টা… মনে মনে একটু বিরক্তিই এলো। ঋতম বুঝল, ওর চলে যাওয়া উচিৎ এখনই। বাবারা বোধহয় সব বোঝে। “সবটা না বলে যাবি না।“ বলে ছেলের হাতটা ধরল প্রিয়ব্রত। একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “মেঘাশ্রী কে? বল বাবান বল?” এবার বিরক্তিটা চরম পর্যায় পৌঁছে গেল ঋতমের। “উঁচু গলায় বলল, “জানতে চাও মেঘা কে? সহ্য করতে পারবে তো? মেঘা মধুমিতা দত্ত’র মেয়ে, সেই মধুমিতা দত্ত যে তোমার সাথে জলপাইগুড়িতে কাজ করতেন। মেঘা তোমাদের দুজনের মেয়ে। এবার জেনে শান্তি তো?” এক লহমায় যেন পায়ের তলার মাটি সরে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে প্রিয়ব্রত। একটা ঝাপসা রাত, এক প্রাণোচ্ছল যুবতী, সব যেন সিনেমার মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এটা কি করে সম্ভব? ঋতমের হঠাৎ সম্বিত ফিরল। এমনভাবে কথাটা বলা উচিৎ হয়নি। তার বাবার মনের মধ্যে বয়ে চলা ঝড়ের আভাস সে পাচ্ছে। আর এই জন্যই সবকিছু ও নিজের মনে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। একবার ডাকল, “বাবা..” প্রিয়ব্রত বুঝতে পারছে না কি করবে। পালিয়ে যাবে নাকি ছেলের কাছে… ঋতম নিজেকে একটু সহজ করার চেষ্টা করে বলল, “এসব বাদ দাও বাবা, নীচে চলো। মা চিন্তা করবে। এটুকু মুহুর্ত শুধু আমাদের দুজনের মধ্যে থাকবে।“ প্রিয়বত ছেলের হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বলল, “বিশ্বাস কর আমি জানতাম না, আমি জানতামই না আমার দ্বিতীয় কোনো সন্তান… বিশ্বাস কর আমি তোকে, তোর মাকে ঠকাইনি। মধুমিতাকেও আমি ঠকাতে চাইনি। বিশ্বাস কর বাবান। মধুমিতা যে আমায় পছন্দ করতো সেটা আমি বুঝতাম, কিন্তু আমি কোনদিনও পাত্তা দিতাম না। সেই রাতে যে…” ঋতম ওর বাবাকে চুপ করাতে বলল, “কে বলেছে আমি তোমায় বিশ্বাস করিনা। আমি তোমায় বিশ্বাস করি। আমি জানি তুমি ইচ্ছাকৃত কখনো কাউকে ঠকাতে পারো না। আমার কষ্ট তো শুধু মেঘার জন্য হচ্ছে, বেচারি জীবনে কিছুই পেলো না। আমার সাথে আলাপ না হলে একটা সংসার অন্তত পেতো।“ প্রিয়ব্রত যেন কিছু আঁকরে ধরে বাঁচতে চাইল, বলল, “তোরা দূরে কোথাও চলে যা।“ “তা হয়না বাবা”, বলে আর দাঁড়াল না। ছেলের চলে যাওয়ার পথে সজল চোখে চেয়ে রইল প্রিয়ব্রত। ২৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তার জীবনে কোন প্রভাব ফেলল না, অথচ ওর ছেলেকে এত বড় আঘাত দিল? যে অধ্যায়টা সহজে শেষ করে দিয়ে ভুলে গিয়েছিল, সেটা আবার ফিরে এল, তাও ছেলের জীবনে। এই আঘাত যে কতটা গভীর, তা একজন বাবা’ই অনুভব করতে পারবে। প্রিয়ব্রত আকাশের দিকে তাকাল, বৃষ্টি নেমেছে নিঝুম রাতে। ওর কষ্টে হয়তো আকাশেরও কান্না পেল।ঋতম - Image of a lonely and sad person

গল্প কি আর শেষ থেকে পড়া যায়? তাই যদি না পড়া হয়ে থাকে পড়ুন শেষ বলে কিছ নেই- পর্ব এক

ব্যস্ত এই দুনিয়াতে সবাই কমবেশী কাজে মশগুল। তাই অনুলিপির সব আপডেট পেতে চোখ রাখুন অনুলিপির ফেসবুক পেজে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *