“গলার আওয়াজ পেয়ে নুপুরের হিল্লোল তুলে নেমে এলো মিতিল। তার প্রাণের বন্ধু এসেছে বলে কথা। আজ যেন মিতিল পাহাড়ী ঝর্নার মতো প্রাণোচ্ছল। কারণ কাল কন্যার বিয়া। তার হাতের মেহেন্দি থেকে ঠোঁটের হাসি, সবই যেন রঙ্গিন। তাতে আরো কিছুটা বাড়তি আনন্দ এনেছে আরোহীর হঠাৎ আগমন। আরোহী মিতিল এর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আজ সব যেন কেমন সিনেমার মতো পারফেক্ট লাগছে ওর। আরোহীকে জড়িয়ে ধরে প্রায় লাফাতে লাফাতে বলল, “তুই যে আসবি আমি তো ভাবতেই পারিনি। দু মাস ধরে কোন যোগাযোগ করিসনি কেন?” আরোহী যেন একটু থমকালো। তারপর হাসির হিল্লোল তুলে বলল, “তোকে কি সুন্দর লাগছে রে। আর কি করে ভাবলি যে তোর বিয়ে আর আমি আসব না। কিন্তু আমি কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব?” মিতিলের বাবা এবার বললেন, “একদমই না, তুই মিতিলের ঘরে যা, আমিও একটু পর তোর কাকিমাকে নিয়ে যাচ্ছি। তোর বেঙ্গালুরুর গল্প শুনব একটু।“ আরোহী যেন একটু অনিচ্ছা সহকারে হাসল। বলল, “তেমন কিছু শোনার নেই কাকু। মাঝে মাঝে আর ভালোলাগে না কাজ টাজ।“
ভোর ৪টে ৪০, অধিকারি বাড়ি উলু ও শঙ্খধ্বনিতে মেতে উঠেছে মিতিলের অধিবাসের অনুষ্ঠানে। মিতিল এমনিতে তার বিয়ে নিয়ে বেশ খুশি। কি বলবে এই বিয়েটাকে? লাভ ম্যারেজ? সুজাত’র সাথে আলাপ সোস্যাল মিডিয়াতে, ভালোলাগাটা ভালোবাসায় তখনও পরিনত হয়নি পুরোপুরি, মিতিলের বাবা ওর অন্য এক সম্বন্ধের কথা বলে। মিতিল সুজাতকে সে কথা জানাতেই ও মিতিলের বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে চায়। মিতিলের মনে পড়ছে সেই রাতটার কথা, যেদিন ফোনে ও বলেছিল যে, ও চায় না কোন পাত্রপক্ষের সামনে বসতে। সুজাত সাথে সাথে উওর দিয়েছিল, “বসতে হবেও না। আমি তোমার বাবা-মা’র সাথে কথা বলতে চাই।“ মিতিল খুব অবাক হয়েছিল। বলেছিল, “কথা বলবে? কি নিয়ে? বিয়ে নিয়ে? আমরা একে অপরকে চিনি কতদিন? সাত মাস? মাত্র দুবার দেখা। বিয়ে করার জন্য কি যথেষ্ট?” প্রত্যুত্তরে সুজাত বলেছিল, অবশ্যই যথেষ্ট। আমাদের বাবা-মা’রা একে অপরকে কতটুকু চিনে বিয়ে করেছিলেন? তবে তোমার আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা না হলে সেটা আলাদা কথা।“ মিতিল একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল, “আমি কি বলছি সে কথা? কিন্তু তাও যুগ বদলেছে, এভাবে বিয়ে হয় নাকি? আর তুমি তো আমায় বিয়ে নিয়ে কিছু বলনি।এমনকি তুমি আমায় নিয়ে কি ভাবো, তাও কিছু বলোনি সেভাবে কখনো।“ সুজাত একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “আমি একটু কম কথার মানুষ নীহারিকা। ভেবেছিলাম সব কথা স্পষ্ট করে না বললেও তুমি বুঝে নেবে ঠিক। তুমি কি একদমই কিছু বোঝনি? পাত্রপক্ষের সামনে বসতে না চাওয়ার আবদারটা কি এমনি করলে? তাছাড়া বিয়ে নিয়ে আমি এখনই কিছু ভাবতেও চাই নি। শুধু তুমি চাও না পাত্রপক্ষের সামনে বসতে তাই বললাম।“ মিতিল একটু লজ্জা পেয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিল বিয়ের বিষয়টা এভাবে না বললেই ভালো হতো। সেই রাতের পর থেকে আজকের দিনটার মধ্যে ব্যবধান মাত্র আট মাস। এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে ওর খুব একটা সায় ছিল না, বলেও ছিল সে কথা সুজাতকে। তার উত্তরে সুজাত বলেছিল, “আমি কি করব দিন তো তোমার বাবা ঠিক করেছেন। তাছাড়া বিয়ে যখন তোমাকে করব বলে স্থির করেই ফেলেছি, তখন আর দেরি করে কি লাভ?” আরোহীর টোকায় আবার অধিবাসের অনুষ্ঠানে মনটা ফিরল মিতিলের। আরোহী বলল “আর ভাবিস না বরের কথা। আচ্ছা তোর বর আই.টি তে চাকরি করে তাই না?” মিতিল সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। “তুই বিয়ের পরও চাকরিটা করবি তো?” এবার পিছন থেকে উত্তর দিলেন মিতিলের বাবা। “কেন করবে না। শাক্য তেমন মানসিকতার ছেলেই না। এমনকি মিতিলের শাশুড়ি মা’ও চাকরি করতেন। আরোহী মিতিলের দিকে তাকিয়ে বললি,”তুই যে বললি তার নাম সুজাত।“ মিতিল একটু গম্ভীর হয়ে বলল,”ওর ডাকনাম।“ সত্যি বলতে মিতিলের কয়েকটা ব্যাপারে বেশ খটকা লাগে আজও। যেমন, প্রথমবার সুজাতর ওদের বাড়ি এসে ওর বাবার সাথে আলাদা কথা বলা। কেন ওর সামনে কথা বললে কি অসুবিধা? বিয়ে তো ওকেই করবে। আর বাবাকে যে কি এমন বলেছিল যে বাবা এককথায় রাজি হয়ে গেল। যদিও এটা ওর ভালোও লেগেছে। খটকা দুই, ওর আর একটা নাম যে শাক্য এটা ও জানত না ওর বাবা জেনে গেল। এই নিয়ে ওর খুব অভিমানও হয়েছিল। কিন্তু সুজাতর যুক্তির সামনে ও সবসময় হেরেই যায়। আবার স্মৃতির নদীতে গা ভাসাল মিতিল।
সেদিন সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছিল একটানা। চোখে ঘুম নেই মিতিলের। সন্ধ্যাবেলা কার্ড এর বয়ান লিখতে বসে বাবা যখন সুজাতর নামের পাশে ব্র্যাকেটে শাক্য নামটা লিখতে বলেছিল, তখন খুব অবাক হয়েছিল মিতিল। শাক্য কেন? ওর বাবা একটু আমতা আমতা করে বলেছিল, “না মানে ওটা ওর ডাকনাম। আর সুজাতর এই নামটাই বেশি পছন্দ। তাই ও আবদার করেছিল কার্ডে যদি এই নামটা রাখা যায়। মনে মনে রাগ হচ্ছিল খুব। কোনরকমে বয়ানটা লিখেই নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল মিতিল। রাত ন’টা থেকে সাড়ে দশটা অব্দি মোট সাতবার ফোন করেছিল, একবারও ধরেনি। কি এমন কাজে ব্যস্ত ও? মাঝে মাঝে ওর খুব চিন্তা হয়, ও যেমন চেনে সুজাত তেমনই তো? নাকি অন্য মানুষ? খুব কি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে বিয়েটা? রাত প্রায় বারোটা কুড়ি, শুয়ে শুয়ে আকাশকুসুম ভেবে চলেছে মিতিল। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠেছিল। ফোন ধরতেই সুজাত একটু চিন্তিত গলায় বলেছিল, “কি হয়েছে নীহারিকা? কিছু অঘটন ঘটেছে?” মিতিল বিরক্তির সুরে বলেছিল, “অঘটন না হলে যে তোমায় ফোন করা যাবেনা, এটা তো বলে দেওয়া ছিল তোমার।“ সুজাত হালকা হেসে বলল, “এমা তা কেন হবে, আসলে সাতটা মিসকল দেখে আমার একটু চিন্তা হচ্ছিল। তা আবহাওয়া এমন গরম কেন? কি হয়েছে? আমি ফোন ধরিনি বলে রাগ হয়েছে? আসলে ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল। বুঝিনি তুমি এতোবার ফোন করতে পারো, আসলে আমাদের…” মিতিল যেন আরো বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। রেগে বলেছিল, “আমাকে কি তোমার কাজের কৈফয়ত চাওয়ার মতো মেয়ে মনে হলো? আর ফোন না ধরার থেকেও বেশি রাগের কারন আছে।“ সুজাত বলেছিল, “এইরে, এবার তো বেশ ভয় ভয় করছে আমার।“ মিতিল আর কিছু বলতে না দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার ডাকনাম যে শাক্য তুমি আমায় বলোনি তো?” সুজাত একটু চুপ থেকে বলেছিল, “কেন নামটা কি খুব অপছন্দ?” মিতিল একটু চেঁচিয়ে বলেছিল, “পছন্দ- অপছন্দের প্রশ্ন নয়, আমি জানব না, আমার বাবা জানবে এটা কেমন কথা। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় আমি না, বাবা তোমায় আগে থেকে চেনে। তোমায় তো আমার থেকে বাবা বেশি ভালো বোঝে।“ সুজাত মজার সুরে বলেছিল, “সেটা কার ব্যর্থতা? তুমি তো জানতে চাওনি কখনো। আমি যেচে কেন বলবো? আর তোমার বাবা অভিজ্ঞ মানুষ, তাই তোমার থেকে বেশি আমায় বুঝে গেছে। এতে রাগ করার কি আছে?” মিতিল যুক্তির চাপ নিতে নিতেও বলেছিল, “সে তো তুমিও কখনো জানতে চাওনি আমার ডাকনাম।“ সুজাত ঠাট্টার সুরে বলেছিল, সে জানতে চাই নি, কিন্তু কখনো বলাও হয়নি মিতিল নামটা তোমার মতোই মিষ্টি। আমি তোমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি। যেমন, পাহাড়ে ঘুরতে যেতে, ফুচকা খেতে, মোমো খেতে, ভূতের সিনেমা ইচ্ছা করে দেখে ভয় পেতে তোমার খুব ভালো লাগে।“ মিতিল বলেছিল, “সেটাই তো খটকা। আমি না বললেও তুমি এতোকিছু জানো কি করে? মাঝে মাঝে ভাবি কতটুকু জানি আমি তোমায়? এটাকে কি আদৌ লাভ ম্যারেজ বলা যায়? ” সুজাত বলেছিল, “ম্যারেজটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন। বাকিটা যে যার মতো ধরে নিক। আর আমাদের একে অপরকে জানার জন্যই তো এতো আয়োজন। দেখো, আবার জেনে বুঝে আফশোস করবে না তো? তবে নীহারিকা এখন একটা জিনিস তোমায় সত্যি জানাতে চাই, আমার না এখনো ডিনার করা হয়নি, বাকিটা যদি কাল জানো।“ মিতিল লজ্জা পেয়ে বলল, “এমা, আমারই বোঝা উচিৎ ছিল। আমি রাখছি তুমি…” সুজাত বলে উঠল, “না। রাখার আগে বলি, কাল বিকালে এই পাঁচটা নাগাদ একটু দেখা করবে?” মিতিল অবাক হয়ে বলেছিল, “কেন?” সুজাত আদুরে গলায় বলেছিল, তোমায় দেখতে চাই এই কারনটা কি যথেষ্ট? তবে তোমাকে দেখার পরও সময় থাকলে কিছু কেনাকাটাও করে নেওয়া যায়। এবার মাথা ঠান্ডা করে ঘুমিয়ে পড়ো। বিয়ের কনের রাত জাগা ঠিক না। এরপর তো জাগিয়ে রাখবোই।“ ধ্যাত বলে ফোন কেটে দিয়েছিল মিতিল, আর ভুলেই গিয়েছিল সন্ধ্যার রাগের কথা।
তবে সবচেয়ে বেশি খটকা লাগল কাল রাতে। সুজাতর ফোন ধরেই শিশুদের মতো উচ্ছ্বল হাসি হেসে মিতিল বলেছিল, “জানো আজ কি হয়েছে? আজ বিকালে বেঙ্গালুরু থেকে আরোহী এসেছে।“ সুজাত বলেছিল, “কে এসেছে?” মিতিল বলল, “আরোহী। আমার ছোট্টবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম ও আসতেই পারবে না।“ সুজাত যেন খুব আনন্দিত। হেসে বলল, “সত্যি এতো দারুন খবর। তা কাল আলাপ করাচ্ছ তো তোমার বান্ধবীর সাথে? এবার মনে হচ্ছে আমাদের বিয়ে করাটা সার্থক।“ মিতিল খুব অবাক হয়েছিল, “মানে? ও না এলে কি আমাদের বিয়েটা তোমার কাছে অর্থহীন হয়ে যেত? আমার বন্ধু আসায় আমার থেকে দেখছি তুমি বেশি খুশি।“ সুজাত যে বেশ চাপে পড়েছে, সেটা ওর মৌনতা বলে দিচ্ছে। আমতা আমতা করে বলেছিল, “না মানে ঠিক তেমন না। আমি তো খুশি হলাম তুমি খুশি হয়েছো বলে।“ মিতিল বেশ বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “সত্যিই কি তাই? নাকি আরো কোনো বিষয় আছে? হ্যাঁ আমি খুশি হয়েছি ঠিকই, কিন্তু এতোটাও নয় যে, ও না এলে আমি বিয়েটাকে অর্থহীন ভাববো। সুজাত তুমি কি আমার থেকে কিছু লোকাচ্ছো?” “এমা না না। তুমি যেমনটা…” এই প্রথমবার নিজের কোর্টে বল পেয়ছিল মিতিল। সুজাতকে চুপ করিয়ে বলেছিল, “তাহলে এতো অপ্রস্তুত হচ্ছো কেন? যুক্তির মহাগুরুর কাছে কি যুক্তির অভাব হচ্ছে?” শব্দ করে হেসে উঠেছিল সুজাত। বলেছিল, “নামটা বেশ দিয়েছ তো। হ্যাঁ আমি যুক্তি দিয়ে সব বোঝাই ঠিক, কিন্তু সেটা কি অন্যায়? তুমি জানো বিয়ের দিন বউ এর বন্ধুরা কতো গুরুত্বপূর্ন মানুষ হয়? আরে শালী তো আধি ঘরওয়ালী হয়। বিয়ে করায় একটা আলাদা মজা আসবে। আর কাল বিয়ে, আজ তুমি বরের ওপর সন্দেহ করছো? এটা ঠিক।?” মিতিল চুপ করে গেল। নীহারিকা, আমি জানি ঝগড়া করলে প্রেম বাড়ে, কিন্তু তাই বলে বিয়ের আগের রাতে?” তারপর একটু হালকা সুরে বলল, “আচ্ছা একটা আবদার রাখবে?” মিতিলের রাগটা কেমন যেন নরম হয়ে অভিমানে পরিণত হতে লাগল। সুজাত এই কয়েক মাসে খুব ভালো করে বুঝে গেছে, মিতিলের মন কি করে গলাতে হয়। এবার আরো আদুরে গলায় বলল, ও মিতিল ম্যাডাম এখনো রাগ করে আছো? আচ্ছা সরি।“ মিতিল এবার হেসে ফেলল, “খুব হয়েছে। আবার মিতিল…. বলো কি আবদার?” সুজাত হেসে বলল, “যাক শান্তি। বলছি, আমার এক জামাইবাবু আর মামা সকালে তত্ত্ব নিয়ে এসে তোমাদের বাড়ি থাকবে। অসুবিধা নেই তো?” মিতিল বলেছিল “ এমা না না কিসের অসুবিধা।“
কাল বলেছিল ঠিক’ই, কিন্তু আজ কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। শুধু মিতিল না আরোহীর ও মনে হচ্ছে ওনারা কেমন সন্দেহজনক। মিতিলের একটা অন্যরকম সন্দেহ করছে। সুজাতর মামারা যেন আরোহীর ব্যাপারে একটু বেশিই আগ্রহী। গতকাল আরোহী এসেছে শুনে সুজাতও খুব খুশি হলো। তাহলে কি ওদের পরিবার আগে থেকে আরোহীকে চেনে? যদি চিনেও থাকে তাহলে সেটা লোকানোর কি আছে? আর আরোহীও যেন কেমন ভয় ভয়ে আছে। যদিও আরোহী বলল ওনাদের চেনে না। ধুর বাবা আনন্দ করে বিয়ে করবে? নাকি মনের খচখচানি নিয়ে তদন্ত করবে। মনে মনে বিরক্ত হলো মিতিল।
সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ শাঁখের আওয়াজে মেতে উঠল বিয়েবাড়ী, বরবেশে সুজাতর আগমন হয়েছে যে। আরোহী বলল, যাই তোর কর্তামশাইকে দেখে আসি। মিতিল ঘরে একা আয়নায় নিজেকে দেখছে। লাল বেনারসী, সোনার গয়না, চন্দনের সাজ, সাদা গোলাপের মালায় অন্যরকম লাগল নিজেকে। এমন সুন্দর করে বোধহয় জীবনে একবারই সাজা যায়। মনে হলো ছুটে গিয়ে দেখে আসে একবার সুজাতকে। কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে সবকিছু। এমনটাই কি হয় বিয়ের অনুভূতি? হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল, মিতিল ফোন ধরতেই সুজাত বলল, “বান্দা হাজির, বিয়ে করবেন তো?” ধ্যাত বলে হেসে ফেলল মিতিল।
আরোহীর কেমন যেন খটকা লাগছে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে এবার ওর এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। অনেক জোড়া চোখ যেন ওকেই ফলো করে যাচ্ছে গোপনে। বস চায়নি ও এখানে আসুক, একপ্রকার জোর করেই এসেছে। কিছু গোলমাল হলে? ধুর এই ভয়ে ভয়ে জীবন কাটানো আর ভালোলাগে না। মিতিলের বিয়ে তো হয়ে গেল। ওর আবদারে বাসরও জাগতে হলো। আর না, কাল ভোরের টিকিটের ব্যাবস্থা করতে বললেই হয় বসকে। সামনে বড় প্রোজেক্ট।পাশে বসা মিতিলকে আগামীকাল ফিরে যাওয়ার কথা বলতেই মিতিলের আগে উত্তর দিল সুজাত। “পালিয়ে যেতে দিচ্ছি না।“ আরোহী কি একটু ভয় পেলো? বলল,”মানে?” সুজাত হেসে বলল, “মানে আমার বাড়ির অনুষ্ঠান না মেটা অব্দি কোথাও যাওয়া চলবে না। একটা সম্পুর্ন নতুন পরিবেশে যাবে কাল নীহারিকা, আর প্রিয় বন্ধু হয়ে তুমি তার পাশে থাকবে না? আমার মতে কাল তুমি আমাদের সাথে চলো, পরশু অনুষ্ঠান মিটিয়ে ওর বাবা, মা’র সাথে ফিরে এসো। তোমার বন্ধু ও একজন চেনা মানুষ পাবে অচেনা পরিবেশে। মিতিল মুখে বলল, হ্যাঁ এটাই সবচেয়ে ভালো হবে। তবে মনে মনে ভাবল, সত্যিই কি সুজাত এতোটা বোঝে ওর ব্যাপারে? নাকি আরোহী বলে এতো আগ্রহ? হঠাৎ সুজাত কানের কাছে এসে বলল, “জেলাস হচ্ছো? ও আমার আধি ঘরওয়ালি তো।“ হেসে ফেলল মিতিল। অবাক লাগে, সুজাত কি করে বুঝে যায়? ও রাগ করবে ভাবলেই মনটা গলিয়ে দেয়।
সব অনুষ্ঠান মিটে গেছে, এবার ফিরে যাওয়াই ভালো আরোহীর। কাল ভোরের টিকিটের ব্যাবস্থাও হয়ে গেছে। এখানে আর থাকা নিরাপদ নয় ওর জন্য। কেমন যেন একটা খটকা লাগছে। সুজাত ও তার পরিবারের কিছু লোকের এই অতিতৎপরতা ভালো লাগছে না। সুজাতর সাথে মিতিলও জোর করল বলে বাধ্য হলো অনুষ্ঠান বাড়ী থেকে আবার সুজাতদের ফ্ল্যাটে আসতে। এসে কেমন যেন একটা লাগছে। মিতিল টোকা মেরে বলল,” কি ভাবছিস এতো? তুই থাকাতে আমার বিয়েটা আরো মজাদার হলো। তুই সারাক্ষন আমার সাথে থাকায় আমারও খুব সুবিধা হয়েছে। “হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল, “সুজাত আসতে পারো” বলেই দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে গেল মিতিল, তিনজন পুলিশ অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে। মুহুর্তে বদলে যেতে দেখল আরোহীর মুখের রঙ। চেঁচিয়ে উঠল মিতিল, “কি ব্যাপার আপনারা কারা? এসব কি?” কখন নিশব্দে সুজাত পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পাড়েনি, দু কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি আছি, শক্ত করো মনকে। অবাক চোখে তাকাল মিতিল সুজাতর দিকে, যেন অন্য একটা মানুষ।
পরবর্তী আধঘন্টা যেন সিনেমার মতো কেটে গেল। কিছুই বুঝতে পারছে না মিতিল। আরোহীকে ওরা তুলে নিয়ে গেল। ও নাকি মিস অ্যানা? ও নাকি শিশু পাচার করে। ছোট্টবেলার বন্ধু আরোহী। সে এমন কিছু করতে পারে এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু আরোহীর মুখেও যে অপরাধির ছাপ ছিল। বার বার বলছিল ওকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই মিতিল এতোকিছু প্ল্যান করেছে। কিন্তু কি করে ওকে বোঝাবে যে মিতিল নিজেই কিছু বুঝতে পারছে না। ও যে এসবের কিছুই জানত না। একবার তাকিয়েছিল সুজাতর দিকে, চোখের ইশারায় সুজাত চুপ করে থাকতে বলেছিল। এখন ঘর ফাঁকা। সুজাত জানিয়ে দিল ও কাল অফিসে যাবে। এবার অন্য একটা মিশন সুজাতর সামনে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে সে মিতিলের সামনে। চোখের জল আর থামছে না মিতিলের। কাছের দুজন মানুষই তার কাছে অচেনা এখন। তবে নীরবতা ভঙ্গ করল মিতিলই। “তাহলে মিশন সাকসেসফুল তো অফিসার সুজাত বসু? অবশ্য আমি তো জানিও না যে আপনার নাম সুজাত কিনা। আইটি ইঞ্জিনিয়ার যে আপনি নয় সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু একটা মেয়ের জীবনের এত গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়কেই আপনাকে বাছতে হলো? মানছি আমার বন্ধু অন্যায় করেছে। কিন্তু আর কি কোন উপায় ছিল না আরোহীকে ধরার। আমায় কেন ঠকালেন? আমি তো সত্যি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। বিয়েটা যে আমি মন থেকে করেছি।“ সুজাত ওরফে শাক্য কিছু বলতে গিয়েও পারলনা শুধু একটু কাছে এগিয়ে গেল মিতিলের। মিতিল অঝোরে কাঁদছে, বলল, “এবার আমার ছুটি তো? আমি নিশ্চই কাল আমার বাড়ি চলে যেতে পারি। আর তো নাটকের প্রয়োজন নেই।“ এবার এগিয়ে এসে মিতিলকে জড়িয়ে ধরল শাক্য। শান্ত গলায় বলল, “নিশ্চই বাড়ি যাবে, তবে আগামিকাল নয়, পরের সপ্তাহে, তুমি একা না, আমরা দুজনেই যাবো অষ্টমঙ্গলায়। মিতিল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আরোহী তো ধরা পড়ে গেছে, আর নাটকের কি প্রয়োজন? শাক্য মিতিলকে এনে বিছানায় বসাল, ফুলের সাজের শয্যা দেখে মিতিলের আরো কান্না পেলো। কত স্বপ্ন ছিল ওর এই রাতটা নিয়ে। মিতিলের দুই হাত নিজের মুঠোর মধ্যে ভরে মাথা নামিয়ে সুজাত বলল, “আমি তোমার কাছে অপরাধী। আমার সব কথা শোনার পর তুমি শাস্তী ঠিক করো। হ্যাঁ আমি মানছি আমি অনেক মিথ্যা বলেছি তোমায়। কিন্তু সবটা মিথ্যা নয়। এই বিয়েটা তো নয়ই। তুমি ঠিকই বলেছো, আমার নাম সুজাত নয়। তবে তুমি আমার নাম জানো। আমি শাক্য, শাক্য বসু। এটাই আমার ভালোনাম। আরো একশোটা বাঙালি ছেলের মতো আমারও ডাকনাম বাবাই। লালবাজারে চাকরি করি। অ্যানাকে ধরাটা আমার কাছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। অ্যানা পর্যন্ত আমরা কিছুতেই পৌঁছাতে পারছিলাম না। অনেক ডাকাবুকো মানুষের ছত্রছায়ায় থাকত ও। অনেক কষ্টে জানতে পারি তার প্রিয়বন্ধুর নাম নীহারিকা, যার সাথে ও মাঝে মাঝেই যোগাযোগ করে। কোলকাতার সাথে ওর যোগসূত্র শুধু তুমি। আর ওর ঘেরাটোপের বাইরে না আনলে ওকে ধরা সম্ভব নয়। এটা সত্যি যে তোমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম শুধুমাত্র অ্যানা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। কারন এটাই তখন সবচেয়ে সহজ উপায় মনে হয়েছিল। তারজন্য তোমার ব্যাপারেও অনেক খোঁজখবর নিতে হয়েছে আমায়। কিন্তু আস্তে আস্তে, তোমার বন্ধু হতে গিয়ে ভালোবেসে ফেললাম তোমায়। তবে বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবিনি, সত্যি বলছি। কিন্তু সেই রাতে তোমার কথা শুনে ভাবলাম,এটাই সবচেয়ে ভালো সুযোগ অ্যানাকে ওর ছত্রছায়ার বাইরে এনে আমাদের হাতে পাওয়ার। যদিও তখনও জানতাম না ও আসবেই কিনা, কিন্তু এটুকু রিস্ক তো আমাদের নিতেই হতো। আর তার থেকেও গুরুত্বপুর্ন হলো, তোমাকে আমি হারাতে পারতাম না। এরপর সবটাই তোমার জানা। তবে তোমার বাবা সবটা জানতেন। ওনাকে প্রথম দিনই আমি সব বলেছি। তাই আলাদা করে কথা বলার প্রয়োজন হয়েছিল। প্রাক্তন আর্মি অফিসার তোমার বাবাও দেশপ্রেম আর সন্তানপ্রেমের দোলাচলে পড়ে রাজি হতে পারছিলেন না প্রথমে। তুমি শুনলে অবাক হবে আমার মা’ও এসব কিছুই জানেন না। আশা করি তোমার মনের সব খটকা আমি দূর করতে পেরেছি। তুমি হয়তো ভাবছো আমি আগেই কেনো অ্যানাকে ধরলাম না। আমার ওপরমহল থেকেও আমায় বিয়ের দিনই ধরার অর্ডার দিয়েছিল। আমি রাজি হয়নি, কারণ তাতে বাকি অনুষ্ঠানগুলো নষ্ট হতো। আর এতো নাটকের মাঝে বিয়েটা যে সত্যি ছিল। তাই অ্যানাকে নজরে রাখতে হয়েছিল। নীহারিকা আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি। তোমার বন্ধুও হয়তো মন থেকে এই কাজ করছে না। কিন্তু আইনের চোখে দোষীর দোষটাই গুরুত্ব পায়, মনটা নয়। সব তোমাকে বললাম। এবার তুমি যেমনটা চাও তাই হবে। বলো কি শাস্তি আমার প্রাপ্য? তবে বিয়েটা আমিও মন থেকেই করেছি নীহারিকা।“ অনেকক্ষন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শাক্যকে জড়িয়ে ধরল মিতিল। শাক্য আরো কাছে টেনে নিয়ে হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ মিতিল ম্যাডাম।“
অনুলিপির নতুন আপডেট পেতে ফলো করুন অনুলিপির ফেসবুক পেজ।
শুধু ছোটগল্প নয়, অনুলিপিতে আছে ধারাবাহিক গল্প। যদিও তার সংখ্যা মোটে একটা। তবে খুব তাড়াতাড়ি আসবে পরবর্তী ধারাবাহিক। তাই চোখ রাখুন অনুলিপির ধারাবাহিক পেজে।